top of page

গোয়েন্দার খোঁজে

Writer's picture: Priyabrata SahooPriyabrata Sahoo

Updated: May 23, 2024



আমি হ্যান্ডশেক করে বললাম, "আপনি তাহলে গজেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী? এর আগে আপনার সঙ্গে পরিচয় না হলেও আপনার অনেক কথা আমি শুনেছি।"

গজেন বাবু তখন একটা গরম চপকে কায়দা করতে ব্যস্ত। অর্ধেকটা চপ মুখের ভিতর ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন গরম-ঠান্ডা বিচার না করেই। 'ঠেলার নাম বাবাজি' তা টের পেয়েই না পারছেন গিলতে, না পারছেন ফেলতে। অনেক কায়দা কসরতের পর চপ যখন আয়ত্তে এল তখন গজেনবাবু চোখের জলে, নাকের জলে একাকার হয়ে গেছেন।

গজেন বাবু এরপরও প্লেট থেকে একটা পকোড়া তুলে নিয়ে এমনভাবে দন্ত বিকশিত করলেন যেন খানিক আগে কিছুই ঘটেনি। একগাল হেসে বললেন, "আমার নাম তো শুনবেনই, ওয়েস্টবেঙ্গলে এমন কোন ক্রিমিনাল নেই যে গজেন গাঙ্গুলীর নাম শোনেনি।"

আমি বড় বড় চোখ করে গজেন বাবুর দিকে তাকিয়ে বললাম, "তার মানে আমি ক্রিমিনাল?"

"সে তো বটেই আমি আপনি সবাই ছোট বড় ক্রিমিনাল। কেন, আপনি পিঁপড়ে মারেন না? কেঁচো দিয়ে মাছ ধরেন না? মশা, মাছি, শুয়োপোকা, কেন্নো— এদের মারেন না? তারা কি বাস্তুতন্ত্রের বাইরে যে তাদের মারা ন্যায়সঙ্গত হবে?"

গজেনবাবুর সঙ্গে এইসব কথাবার্তা হচ্ছিল রামগোপালদার বাড়িতে। সঙ্গে আমার সহকর্মী খগেনও ছিল। চা-চপ-পকোড়া আর পিওর দেশি মুড়ি সহযোগে আমাদের সান্ধ্যকালীন আড্ডাটা বেশ জমে উঠেছে।

এখানে আমাদের একটু পরিচয় দেওয়া দরকার আমি আর খগেন একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করি। রামগোপালদা উকিল হিসেবে ইদানিং বেশ পসার জমাতে শুরু করেছেন।আমরা তিনজনই প্রায় সমবয়সী। তবে গজেনদা হলো গিয়ে আমাদের পিসতুতো দাদা— যিনি গোয়েন্দা হিসেবে দারুণ সুনাম কুড়িয়েছেন।

আমার প্রবল ইচ্ছা কোন নামকরা গোয়েন্দার অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে কাজ করি। মানে অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে সবকিছু শিখে-টিখে নিয়ে গোয়েন্দা হবো আর কি।

এইসব প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করা পোষায় না। কখন চাকরি থাকবে আর কখন চলে যাবে তা কেউ বলতে পারে না। তার চেয়ে গোয়েন্দা এজেন্সি খোলা অনেক ভালো। স্বাধীন চাকরি।

তাছাড়া আমি গোয়েন্দাগিরিকে যথেষ্ট প্রীতির চোখে দেখি। শার্লক হোমস, ব্যোমকেশ, ফেলুদা পড়ে জেনেছি পুলিশরা গোয়েন্দাদের রীতিমতো সমীহ করে চলে। এটা একটা বড় পাওনা। কারণ, পুলিশের প্রতি আমার একটা রাগ আছে। একবার হয়েছিল কী, আমি আর আমার শালা বাইকে চড়ে কাঁঠাল নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছিলাম। হঠাৎ মাঝরাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ ধরল। লাইসেন্স থাকা সত্ত্বেও এটা নেই, ওটা নেই, এটা সারাননি কেন, অ্যাক্সিডেন্ট হলে কী করবেন, এসব বায়নাক্কা করে ঘুষ হিসেবে কাঁঠালটাই কেড়ে নিল।

সেবার বউয়ের হাতে শ্বশুর বাড়িতে যা বেইজ্জত হয়েছিলাম তা আর বলার নয়। সেই থেকে সুযোগ খুঁজছি কীভাবে পুলিশকে ধাতানি দেওয়া যায়। তারই উপায় হিসেবে গোয়েন্দা শরণাপন্ন হয়েছি।

তবে এর আগে অন্য কোনো গোয়েন্দার যে খোঁজ পাইনি তা নয়। কিন্তু তাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়া যায় না। কেউ বয়সে ছোট, কারুর মেজাজ তিরিক্ষি, কারুর অলরেডি দুজন অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে। আজ তাই রামগোপালদার বাড়িতে গজেনবাবু এসেছেন খবর পেয়ে না ছুটে এসে পারিনি।

গজেন বাবুর অবশ্য একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে। তবে একজনের বেশি দুজন অ্যাসিস্ট্যান্ট কি রাখতে নেই? সেই আশা-ভরসাতেই আমি ছুটে এসেছি। আর আমার পিছু পিছু খগেন এসেছে গল্প শোনার লোভে।

গজন বাবুর পেশীবহুল চেহারা, ঝাঁকড়া চুল, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যায় তিনি একজন গোয়েন্দা। আপাতদৃষ্টিতে গজেনবাবুকে রাশভারী ও গম্ভীর স্বভাবের মানুষ বলে মনে হলেও তার কথাবার্তা শুনে কিন্তু তা মনে হয় না।

রামগোপালদা চানাচুর চিবুতে চিবুতে বললেন, "তুমি বরং তোমার দু একটা কেসের কাহিনী শোনাও, আমরা সবাই শুনি।"

খগেন আহ্লাদিত হয়ে বলল, "সেই গল্প শুনতেই তো আসা। আসলে কোনো গোয়েন্দা সঙ্গে এর আগে কখনো তো সামনাসামনি সাক্ষাৎ হয়নি, ফেলুদা, কিরীটী, শার্লক হোমস— এদের সঙ্গে বইতেই সাক্ষাৎ ঘটেছে।"


"ছোঃ, ওরা আবার কোনো গোয়েন্দা না কি? গজেনবাবু এমনভাবে নাক মুখ বিকৃত করলেন যেন তাকে কেউ তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তেতো ওষুধ গেলাচ্ছে।"

আমি বেশ খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, "সে কী? এদের নামে অপরাধীরা ভয়ে কাঁপে। কী নিপুণভাবে এরা জটিল সব কেস সমাধান করেছে। আর আপনি বলছেন—"

"আরে বাপু, ওরা তো আর অরিজিন্যাল গোয়েন্দা নয়, সবাই গল্পের চরিত্র। গল্পে যেখানে যা ইচ্ছে সাজিয়ে নেওয়া যায়। ওখানে গোয়েন্দা ক্রিমিনাল দুজনেই একই সুতোয় বাঁধা থাকে, আর লাটাই থাকে লেখকের হাতে। গল্পের সঙ্গে বাস্তবের মিল কতটুকু?"

খগেন তবু মানতে চায় না। বলে, "যাই বলুন, গল্পের গোয়েন্দাদের কৃতিত্বটাও কম নয়।"

রামগোপালদা বিরক্ত হয়ে বললেন, "ওসব বাদ দিয়ে আসল কাহিনীই শোনাও না, তুমি বরং তোমার সেই হিরোইন কেসটাই আমাদের শোনাও, পেপারে খানিকটা পড়েছিলাম।"

চায়ে চুমুক দিয়ে গজেনবাবু বললেন, "আসলে কেসটায় বিশেষ কিছু নেই। ছাগল দিয়ে কি আর ধান চাষ হয়! টালিগঞ্জের এক নামি হিরোইন টুসকি সুচতুর কৌশলে সারা ভারতে হেরোইন ছড়িয়ে দিত। সেই হেরোইনকে হিরোইন কীসের মধ্যে পুরে পাচার করতে জানেন?"

আমি আর খগেন সমস্বরে বলে উঠলুম, "কীসে করে?"

"সিম্পল পলিথিনের প্যাকেটে ভরে জুতোর মধ্যে পুরে পাচার করত।"

খগেন আশ্চর্য হয়ে বলল, "জুতোর মধ্যে কোথায় লুকোতো?"

গজেনবাবু খগেনের পায়ের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, "জুতো মানেই চটিজুতো ভাবছেন কেন? বুট কি জুতো নয়?"

এবার আমি বললাম, "সেই হিরোইন বুটের মধ্যে হেরোইন পাচার করত? বাপরে, কী সাহস!"

"হিরোইন বুট পড়তে যাবে কেন? তার শাগরেদরা পরতো। সে যাই হোক, তাদের বমালসমেত ধরেছিলাম টাটানগরে।"

খগেন চোখ কপালে তুলে বললো, "অ্যাঁ, টালিগঞ্জের মাল টাটানগরে?"

"অবাক হচ্ছেন কেন? এ তো সামান্যই, কলকাতার এক মাফিয়াকে একবার ধরেছিলাম কেরালায়, আর একবার একজনকে পাকড়াও করেছিলাম বঙ্গোপসাগরে।"

খগেন হাঁ করে অবাক বিস্ময় গজেন বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি মিনমিন করে জানতে চাইলাম, "বঙ্গোপসাগরে ধরলেন মানে?"

"কী আশ্চর্য! জলদস্যু বঙ্গোপসাগরে থাকবে না তো কি আপনার বাড়ির পচা ডোবাতে থাকবে? মাথার গ্রে ম্যাটারকে একটু বেশি পরিমাণে খাটান না! আর একবার এক ভন্ড জ্যোতিষীকে পাকড়াও করেছিলাম ভূপৃষ্ঠ থেকে পঁচিশ হাজার ফুট উচ্চতায়।"

খগেন বিড়বিড় করে বলে পঁচিশ হাজার ফুট উচ্চতা!"

"হ্যাঁ, এয়ার ইন্ডিয়ার এক বিমানে চড়ে পালাচ্ছিল। বিমানেই তাকে ধরলাম। আর একবার এক খুনিকে ধরেছিলাম আট হাজার আটশো ষাট মিটার গভীরে।"

আমি আশ্চর্য হয়ে বলি, "এত গভীরে কেমন করে ধরলেন? একেবারেই যে অসম্ভব ব্যাপার।"

"আহা বুঝছেন না কেন, হিসেবটা ভূপৃষ্ঠ থেকে নয়, মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া থেকে। মানে মাটির নিচে বারো মিটার গভীরে এক পাতালঘরেই তাকে ধরেছি।"


কৃতজ্ঞতা স্বীকার : কিশোর ভারতী


এইসব কথাবার্তায় রামগোপালদা হাসেনও না বিস্মিতও হন না, বিরক্ত হন। ভুরু কুঁচকে বলেন, "তোমার ওসব গাঁজাখুরি ব্যাপার-স্যাপার ছেড়ে সোজাসুজি গল্পে এসো তো।"

আসলে উকিল মানুষ তো। 'মাই লর্ড ',  'ইয়োর অনার' ইত্যাদি শুনতে ও বলতেই বেশি অভ্যস্ত। তাই গোয়েন্দা আর ক্রিমিনাল এর মধ্যে কখন সওয়াল জবাব হবে সেই আশাতেই বসে আছেন।

যাইহোক রামগোপালদার বিরক্তি দেখে গজেনবাবু এবার নড়েচড়ে বসলেন। সঙ্গে আমরাও। গজেনবাবু পায়ের উপর পা তুলে চোখ বুজিয়ে মুড়ি চিবুতে চিবুতে বললেন, "তাহলে আমার লাস্ট কেসের গল্পটাই বলি শোনো।

"বেশিদিন নয়, মাত্র পাঁচদিন আগেই "জুলি মার্ডার কেস"- টা আমি সলভ করেছি। ঘটনাটা ঘটেছিল তমলুকে। যে আমি গোটা ভারতবর্ষ থেকে ক্রিমিনালদের পাকড়াও করেছি, সেই আমি এই কেসটায় আমার সর্বোচ্চ বুদ্ধি খাটিয়েও কোন কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না— ভাবতে পারো ব্যাপারটা! একবার একতাল গোবর থেকে এক গরুচোরের খোঁজ পেয়েছিলাম আর একবার একটা চবনপ্রাশের শিশি থেকে এক ভন্ড সাধুর ডেরার সন্ধান মিলেছিল, আর এই কেসে সূত্র বলতে কেবল ক্রিমিনালদের ফটো আর তাদের ডেসক্রিপশন।"

আমি হেসে বললুম, "অনেকে তাও পায় না, আপনি তবু ক্রিমিনালদের নামধাম ডেসক্রিপশন পেয়েছেন।"


"আরে বাপু, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। যাদের সন্দেহ করা হয়েছে ও ফটো পাওয়া গেছে, সেই সময় তাদের মধ্যে একজন জেলের মধ্যেই বহাল তবিয়তে ছিল। আর একজন ছিল দীঘায় মামার বাড়িতে। অন্যজন শ্বশুরালয়ে মহানন্দে ছিল। শেষজন সেদিন বন্ধুদের নিয়ে পিকনিকে ব্যস্ত ছিল। এমনকি তাদের ফটোগুলো সব ছোটবেলাকার।"

খগেন এতক্ষণ পরে মুখ খুলল, "অ্যাঁ, তাহলে মার্ডার করল কে?"

"সেটা বিষ্টুবাবুকেই জিজ্ঞেস করুন। উনি তো একটু আগে আমাকে পাত্তাই দিচ্ছিলেন না।"

নিঃশব্দে ব্যঙ্গটা হজম করে নিলুম।

আমাকে একবার দেখে নিয়ে গজেনবাবু বললেন, "তাহলেই বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা অতটা সাদামাঠা নয়। আর পুলিশ করবে এই কেসের ফয়সালা! হাসালে বালক! এ তো লাঙ্গল করতে বলদ এর বদলে ছাগল!"

কিন্তু রামগোপালদা আজকে যেন বিরক্তির প্রতিমূর্তি হয়ে বসে আছেন। এবারে আর রাগ চেপে রাখতে পারলেন না।

"ধুত্তরি! মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে কি অসুবিধা হচ্ছে?"

"শুরুই তো করতে যাচ্ছিলাম। আসলে ব্যাপারগুলো সব জটিল কিনা তাই জটিল করে না বললে ঠিক বুঝতে পারবেন না। ... দিন দশেক আগে আমি ঘরে বসে পেপার পড়ছিলাম। এমন সময় বছর পঞ্চাশের এক ভদ্রমহিলা আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। বৃদ্ধার বাড়ি তমলুকে। সেখানে তাদের বিশাল সম্পত্তি। বাড়ি, গাড়ি সবই আছে। বাড়িতে কর্তা-গিন্নি দুজনে, আর এক ছেলে ও এক মেয়ে থাকে।

"এনারা একটু বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন। সে যাই হোক, কর্তা এখন বাতের ব্যথায় পঙ্গু, হাঁটাচলা বেশিক্ষণ করতে পারেন না। গিন্নি অবশ্য সবল আছেন। তিনি কাছের একটা স্কুলে শিক্ষকতা করেন।

"বৃদ্ধের নাম পিটার, ভদ্রমহিলার নাম মারিয়ম, ছেলের নাম মাইক, মেয়ের নাম জুলি। তবে রবার্ট নামে জুলির এক ছোট ভাই ছিল, কিন্তু সে বছর খানেক আগে মারা গেছে। তবে নাম শুনে আশ্চর্য হয়ো না, এরা কেউই লর্ড ক্লাইভের বংশধর নয়। এরা সবাই পিওর বাঙালি আর এদের প্রত্যেকের পদবী দাস।

"তা সে যাই হোক, ভদ্রমহিলা এসে বললেন, তাদের আদরের ধন জুলিকে কে বা কারা অপহরণ করেছে। আমি বললাম, তবে পুলিশের কাছে গিয়ে ডায়েরী করুন। ভদ্রমহিলা বললেন, থানায় গিয়ে সবকিছু জানিয়েছি। তবে তাদের যা ভাবগতিক, মিনিমাম খুন না হলে তারা এগোবে বলে মনে হয় না। তাই আপনার কাছে এলাম। আমার জুলিকে যদি খুঁজে দেন তো আপনাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেব।

"বললুম, দেখুন ম্যাডাম, অপহরণ যে করা হয়েছে আপনি সেটা বুঝলেন কী করে?"

"বুঝলাম কী করে? এই চিঠিটা পড়ে দেখুন।"

এই বলে ভদ্রমহিলা একটা চিঠি আমার হাতে দিলেন। তাতে লেখা রয়েছে, "জুলিকে নিয়ে চললাম খোঁজার চেষ্টা করো না। ইতি—জুপির মামা।"

"চিঠিটা দেখে বুঝলাম, আসামি বেশ ধুরন্ধর। হাতের লেখা আড়াল করার জন্য চিঠিটা টাইপ করে দিয়েছে।

"দেখুন, জুপি বলে জুলির কোন মামা আছে কি? যদি থাকে তাহলে তাকে চেপে ধরলেই তো কাজ মিটে যায়। বলেই বুঝতে পারলুম, এটা জিজ্ঞেস করা বোকার মত কাজ হয়ে গেছে। কোন অপরাধী কি তাকে ধরার সুবিধার জন্য পরিচয় দিয়ে যাবে?"

"ওর যদি জুপির বলে কোন মামা থাকে তবে আপনার কাছে আসব কী জন্য? জুলির কোন মামা নেই।"

"দেখুন, জুলিকে যে গুম করা হয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু অপহরণ করার কারণ তো থাকবে, চিঠিতে তো কোনো দাবির উল্লেখ নেই।"

"সেটা আপনি খুঁজে বার করুন।"

"আচ্ছা, কখন টের পেলেন যে জুলি বাড়িতে নেই?"

"সকাল আটটার দিকে। কেন-না ওই সময়ে সে যেখানেই থাকুক না কেন আমার কাছে এসে চা-বিস্কুট দিয়ে দিনের খাওয়া শুরু করে। সাড়ে আটটা বেজে গেল অথচ তার কোন পাত্তাই নেই। চাকর-বাকর দিয়ে তখনই চারদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু হল, আর তারপরই বৈঠকখানায় এই চিঠিটা পাওয়া গেল।"

"ঠিক আছে, আপনি এখন বাড়ি যান যান. বিকেলবেলা আপনার বাড়িতে যাব, যা কিছু জানার আছে সেখানেই জেনে নেব। তবে চিন্তা করবেন না, যেহেতু আজ সকালেই অপহরণ করা হয়েছে বিকেলের দিকে কি দুপুরে মুক্তিপণের দাবিতে কেউ ফোন করতে পারে। ফোন করলে নাম্বারটা গুছিয়ে রাখবেন, পরে কাজে লাগবে। আর নতুন কিছু ঘটলে তখনই জানাবেন।

আমি আমার ফোন নাম্বারটা ভদ্রমহিলাকে দিলাম। উনি সেটা নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন। ওদিকে আমি গেলাম আমার কাজে। ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। পিটারবাবুর বাড়ি যাব বলে তৈরি হচ্ছি, তখনি কাঁদো কাঁদো গলায় ভদ্রমহিলার ফোন এল,"জুলিকে মার্ডার করা হয়েছে।"

"সে কী? মুক্তিপণ চাওয়ার আগেই খুন? কী করে জানতে পারলেন?"

"বাড়ির পাশে ঝোপের মধ্যে তার দেহ পাওয়া গেছে। আমার চাকরই প্রথম দেখতে পেয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। আর আমারে চিনতে মোটেই ভুল হয়নি।"

তখনই আমি পিটারবাবুর বাড়ি ছুটলাম। সেখানে গিয়ে আমিও বডিটা দেখলাম। তবে পুরোটা নয়, ধড় থেকে মুন্ডুটা আলাদা হয়ে পড়ে আছে। নাড়িভুঁড়িগুলো একটা পলিথিনের প্যাকেটে ভরা আছে, প্রত্যেকটা পা-ও ছিটকে পড়ে আছে।"

খগেন শিউরে উঠে বললো, "উফ, কী নৃশংস!"

আমি বললাম, "এরকম করে কেউ কাউকে মারতে পারে? ভাবাই যায় না, মানুষ কী নিষ্ঠুর!"

এতক্ষণে রামগোপালদা কথা বললেন। যেহেতু খুনখারাপি শুরু হয়ে গেছে তাই উনি কাহিনীর মধ্যে রস খুঁজে পেয়েছেন। বললেন, "আমার লাইফেও এরকম একটা কেস এসেছিল। সেবার হয়েছিল কী দুই ভাইয়ের সম্পত্তি নিয়ে—"

পাছে আসল কাহিনী চাপা পড়ে যায় সেই ভয়ে খগেন রামগোপালদাকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য বললো, "তারপর গজেনবাবু কী হলো? আসামিকে ধরতে পারলেন?"

রামগোপালদা তার নিজের কাহিনী বলতে না পারায় ব্যাজার মুখ করে বসে রইলেন। ওদিকে গজেনবাবু শুরু করে দিয়েছেন।

"ডেডবডিটা দেখে তো আমার রক্ত গরম হয়ে উঠল। ওদিকে পিটারবাবুদের কান্না দেখে আমার তখন যে কী অবস্থা তা তোমাদের কী বলবো। ... তারপরই শুরু করে দিলাম জিজ্ঞাসাবাদ। চাকর-বাকর থেকে শুরু করে কেউ বাদ গেল না। আর আমার যে কী, তা তো আপনারা জানেন না। কিছুক্ষণ পর সবাই কাহিল হয়ে পড়ল। পিটারবাবুরা কাদের সন্দেহ করেন সেটাও জানলাম। তারা সম্ভাব্য অপরাধীদের সম্পর্কে যথেষ্ট বিবরণ ও পারিবারিক অ্যালবাম থেকে তাদের ছোটবেলাকার ফটোও দিল।

"এখন আমার দায়িত্ব হল বিচার-বিশ্লেষণ করে সবার ভেতর থেকে আসল খুনিকে খুজে বের করা। বেশ বুঝতে পারলাম, পিটারবাবুরা যাদের সন্দেহ করেন তারা ওদের নিকটাত্মীয়, না হলে তাদের ফটো পারিবারিক অ্যালবামে থাকতো না।

"তারপরে খোঁজখবর নিয়ে জানলাম যাদেরকে সন্দেহ করা হয়েছে তাদের মধ্যে গোবিন্দ জুলির অপহরণের আগে থেকেই মামাবাড়ি গেছে। ক্যাবলা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে জেল হাজতে আছে পনেরোদিন হল। এটা পিটার বাবুরা জানতেন না। হাবলু ওদিকে শ্বশুরবাড়িতে। আর শেষজন মাইক সারাদিন বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে পিকনিকে ছিল।"

খগেন অবাক হয়ে বললো, "পিটারবাবুরা তাহলে নিজের ছেলেকেও সন্দেহের বাইরে রাখেনি?"

উত্তরে গজেনবাবু শুধু মুচকি হাসলেন, "ওই চিঠি ছাড়া অপরাধী এমন কোন ক্লু রাখেনি যাতে তাকে ধরা যায়। তাছাড়া সন্দেহের তালিকার বাইরে থাকা অন্য কোন ব্যক্তিও এই কাজ করতে পারে।

গজেনবাবু এরপর জোরে টেবিল চাপড়ে বললেন, "শুধুই তো কিডন্যাপ নয়, মার্ডারও। আসামিকে ধরতে না পারলে আমার নামে কালি পড়ে যাবে। আমার তখন উদভ্রান্ত অবস্থা, নিজেই নিজের উপর বিরক্ত। চার দিন কেটে গেছে অথচ আজ আমি তখনও নাগালের বাইরে।

"সেদিন দুপুরে বিছানায় শুয়ে অন্যমনস্কভাবে ওদের সবার নামগুলো মনে করছিলাম—জুলি, পিটার, রবার্ট, মাইক, মা। আর পরক্ষনেই চমকে উঠলাম। আরে প্রত্যেকটা নামের প্রথম অক্ষরগুলো নিলেই তো দাঁড়ায় "জুপির মামা" । এটাই তো চিঠিতে লেখা ছিল।

"আমি তড়াক করে বিছানায় উঠে বসলাম। একটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। নামগুলো থেকে কর্তা গিন্নির নাম অবশ্যই বাদ দেওয়া যায়, কেননা তারা জুলিকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো এবং জুলির মার্ডারে এদের কোন প্রফিট নেই। রবার্ট তো আগেই মারা গেছে, তাহলে বাকি থাকে কেবলমাত্র মাইক। তবে মাইক কি অপরাধী? কেননা ও সন্দেহের লিস্টে আছে।"

খগেন বলল, "দূর, তা হয় না কি? মাইক নিজের বোনকে খুন করবে কেন? এতে তার প্রফিট কী?"

আমি বললাম, "সম্পত্তির লোভেও তো হতে পারে।"

"কেন? জুলি বিয়ে হলে এমনিতেই তো মাইক সবকিছু পেত। খুন করার মত বোকামি সে করবে কেন?"

"এমনও তো হতে পারে পিটার হয়তো মাইককে কিছুই দিত না।"

এইবার গজেনবাবু বাধা দিয়ে বললেন, "থামুন, থামুন। আসল ঘটনাটা শুনুন। সংকেতটা বুঝতে পারার পরদিনই মাইকের উপর নজরদারি চালালাম। শেষকালে চেপে ধরতেই মাইক ধরা পড়ে গেল।"

রামগোপালদা জিজ্ঞেস করলেন, "মাইক কেন মার্ডার করল?"

গজেনবাবু ঢকঢক করে খানিকটা জল খেয়ে বললেন, "পিটারবাবুদের বাড়িতে মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল, বিশেষত জন্মাবার পর থেকে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি মাইক জুলিকে স্নেহের চোখে দেখত না। একবার তো বিক্রি পর্যন্ত করে দিতে উদ্যত হয়েছিল। সবচেয়ে বড় প্রমাণ মাইক ও তার বন্ধুরা পিকনিকে মাংস খাচ্ছিল।"

খগেন যেন সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনার কথাই শুনল। বলল, "পিকনিকে মাংস খাবে— এতে কী দোষ? তাছাড়া মাংস খাওয়ার সঙ্গে জুলির মার্ডারের সম্পর্ক কী? আচ্ছা মাইকের কি শাস্তি হয়েছিল?"

"এইজন্যে মাইক তার মাষ্টারমশাইয়ের কাছ থেকে আচ্ছা করে বকুনি আর পিটুনি খেয়েছিল।"

রামগোপালদা উকিল মানুষ, অবাক হয়ে বললেন, "সে কী? অপহরণ ও খুনের শাস্তি বকুনি ও পিটুনি? আচ্ছা এটা ভারতীয় আইনের কোন ধারায় পড়ে?"

গজেনবাবু এইবার রীতিমতো হতাশ হয়ে বললেন, "আসলে তোমরা এখনো ব্যাপারটা বুঝতে পারছ না? জুলি ছিল পিটারবাবুদের অতি আদরের পোষ্য পাঁঠার নাম!!"

"অ্যাঁ, পাঁঠা!" বলে খগেন আর আমি গজেনবাবুর মুখের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলাম।

বলা বাহুল্য, এখনও আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়ার জন্য উপযুক্ত গোয়েন্দার খোঁজে রয়েছি। কেন-না পাঁঠা মার্ডার কেসে ঘাম ছুটে যাওয়া গোয়েন্দার অ্যাসিস্ট্যান্ট হতে আমার কোনো ইচ্ছে নেই।

✍️✍️✍️



আমার কথা: এই হাসির গল্পটা কলেজে প্রথম বর্ষে থাকাকালীন লিখি। তারপর সেটা পাঠিয়ে দিই ছোটদের জনপ্ৰিয় "কিশোর ভারতী" পত্রিকায় এবং সেটা ছাপাও হয় ২০১৫, জানুয়ারিতে। আজ অনেকদিন পর সেই গল্পটাই এখানে পুরো তুলে দিলাম। 

সৌজন্যে: কিশোর ভারতী

2 views0 comments

Recent Posts

See All

Comments

Rated 0 out of 5 stars.
No ratings yet

Add a rating

Contact
Information

Energy Materials Laboratory

Centre for Nano and Soft Matter Sciences

Shivanapura, Dasanapura Hobli
Bengaluru, Karnataka, India, 562 162

+91 8101713394

  • Google Scholar
  • ResearchGate
  • ORCID
  • Researcher ID
  • LinkedIn

Thanks for submitting!

©2024 by Priyabrata Sahoo

bottom of page