"ওরে কে কোথায় আছিস? এদিকে একবার ছুটে আয়। এতদিন বাদে মা যে আমার ডাকে আজ সাড়া দিয়েছে রে? মা, মাগো, মা আমার!" -ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসে এভাবেই ডাক ছাড়লেন তান্ত্রিক তিলকানন্দ।
পাশের ঘরে মেঝের উপরেই উপুড় হয়ে শুয়েছিল তিলকানন্দের একমাত্র শিষ্য তেলানন্দ। এই তেলানন্দের সম্পর্কে প্রথমে একটু বলে নেওয়া দরকার। কাশীতে যখন শ্যামাপদ, তিলক তান্ত্রিকের শিষ্য হয়ে এল, তখন থেকেই সে গুরুদেবকে সকাল সন্ধ্যা তেল মালিশ করে দিত। বাতের ব্যাথ্যায় কাহিল গুরুদেব তার শিষ্যেকে দীক্ষা দেবার পর তার নতুন নামকরন করলেন তেলানন্দ! সেই তেলানন্দ কাল রাত্রে গুরুর কাছ থেকে প্রসাদ পেয়ে যখন শুতে গেল তখন সিদ্ধির প্রভাবে তার হিতাহিত জ্ঞানটুকুও লোপ পেয়ে গেছিলো। তাই বিছানা আর মেঝের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনি। যেখানে পেরেছে সেখানেই শুয়ে পড়েছে। সকালবেলা গুরুর এমন হাঁকডাকে সিদ্ধির নেশা ছুটে গিয়ে, সেও উঠে বসে হাঁক ছাড়লো,"কী হয়েছে প্রভু? আপনি এমন করে চেঁচিয়ে উঠলেন কেন?"
-"ওরে তেলু, কাল রাতে মা যে আমাকে স্বপ্নে দেখা দিয়েছেন রে।"
-"আপনার মরা মা আপনাকে স্বপ্নে এসে ভয় দেখালো?" তেলুর নেশা ঠিকমতো কাটেনি তখনো।
-"আমার নিজের মা নয় রে তেলু। এ যে আমাদের সবার মা। মা চামুন্ডা! ওরে তেলু, তুই তাড়াতাড়ি করে পুজোর জোগাড় কর। আজ যে মাকে বড় করে পুজো দিতে হবে। মা, মাগো, মা চামুন্ডা! তুমি এই অধমকে অবশেষে দেখা দিলে মা?"
শেষটায় নিজের মনেই বলতে বলতে তিলক বাবাজী স্নান করতেই চলে গেলেন। তেলু প্রথমে খানিকটা হতবুদ্ধি হয়ে বসে থাকলেও শেষটায় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আর দেরি করলো না। গুরুর আদেশ পালন করার জন্য চটপট করে উঠে পড়লো। স্নানটান সেরে নিয়ে প্রতিদিনের মতো আজও তিলক পুকুরপাড়েই ধ্যানে বসলেন। কিন্তু তিলক মোটেও আজ ধ্যানে মন বসাতে পারছেন না। মনটা বড় বিচলিত হয়ে আছে। হবেই তো, তার এতদিনকার সাধনা আজ সফল হল কিনা। মা আজ তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়েছে। এ কি তার কম প্রাপ্তি? অবশেষে আজ তার তান্ত্রিক জীবন সার্থক হল। তাই ধ্যান করতে বসে তিলকের আজ মনে পড়তে লাগলো পুরোনো দিনের সব কথা।
বছর তিনেক আগে যখন তিলক সাধু সন্ন্যাসী হবে বলে ঘর ছাড়লো, তখন তারাপীঠের এক মস্ত বড় সাধু তাকে পরামর্শ দিল," বেটা এ লাইন তোর না। তোর যেরকম ভাবগতিক তাতে তুই তান্ত্রিক হবার চেষ্টা কর। সবাই মানবে, প্রচুর কাঁচা পয়সা পাবি"!
-"প্রভু, তবে আপনি এই লাইনে কেন? আপনিও তো তান্ত্রিক হতে পারতেন?" অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মঙ্গল। তখনও তার নাম তিলক হয়নি।
বাবাজী একটু এদিক ওদিক চেয়ে গলা নামিয়ে উত্তর দিয়েছিল,"ওরে বোকা। তখন কি আমি এতসব জানতাম রে? এখন আমার বিজনেস মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে বলে আর এ লাইন আমি পাল্টাইনি। নইলে কোনকালে তান্ত্রিক হয়ে যেতাম।"
ওই কথা শুনে মঙ্গল ওখানকারই এক নামজাদা তান্ত্রিকের শিষ্য হবার জন্য ঝুলোঝুলি শুরু করে। ওর নাছোড়বান্দা মনোভাব দেখে কয়েকদিন পর সেই তান্ত্রিক মঙ্গলকে ওর শিষ্য করে নেয়। কিন্তু কিছুদিন পরই কিভাবে বেশি টাকা ইনকাম করা যায়, কিভাবে অমর হওয়া যায় ইত্যাদি সব ভারী ভারী বিদ্যা শেখানোর জন্য সে গুরুকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। মঙ্গলের মতলব ভালো নয় দেখে সেই তান্ত্রিক মঙ্গলকে আর কিছু শেখান নি। ওদিকে গুরুর মতিগতি দিন দুই লক্ষ্য করার পর মঙ্গল সেই তান্ত্রিকের গুরুত্বপূর্ণ বইপত্র, দরকারী জিনিস চুরি করে একদিন চম্পট দিল। তার উদ্দেশ্য একটাই, গুরু যেসব বই পড়ে জ্ঞানলাভ করেছেন সেও সেইসব বইপত্র পড়ে জ্ঞানলাভ করবে।
তারপর ওখান থেকে সে সটান চলে গেল কাশী। বিশ্বনাথের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে নিজেই নিজের নাম রাখলো "তিলক"। দশাশ্বমেধ ঘাটে কিছুদিন ভন্ড সন্ন্যাসী সাজার পর তেলুকে পেল সে। এমন করে কিছুদিন কাশীতে কাটানোর পর তেলুকে সঙ্গে নিয়ে সে এলো পুরুলিয়ার বসন্তপুর গ্রামের এক শ্মশানে। কাশীতে থাকাকালীনই তাকে ওই জায়গার কথা বলেছিল এক সাধু। ওখান থেকেই নাকি বিখ্যাত তান্ত্রিক ট্যারাকালী সাধনায় সফল হয়েছিল। ওই কারণে ওই সাধুও ওখানে কিছুদিন ছিলেন। খুবই নিরিবিলি জায়গা। আশেপাশের লোকেরা প্রায় সবাই মুখ্যু। সাধন ভজন করার আদর্শ জায়গা। এইসব গল্প শুনে তিলকও একদিন বসন্তপুরের টিকিট কেটে ফেলল।
তেলানন্দ ওরফে তেলু অবশ্য তিলককে এক নামজাদা তান্ত্রিক হিসেবেই জানে এবং মানেও। প্রথম যেদিন ও তিলকের কাছে এসেছিল, সেদিন তিলক অন্যান্য লোকেদের মত ওকেও ঢপ মেরে বলেছিল,"বেটা এখুনি বাড়ি ফিরে যা। বাড়িতে ভীষণ বিপদ!" তেলু ওরফে শ্যামাপদ তখুনি ছুটে বাড়ি গিয়েছিল। কাকতলীয়ভাবে সে বাড়ি ফিরে গিয়ে দেখে তার বৃদ্ধা মা হার্টফেল করেছে, প্রায় মর মর। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে যেতে প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছিলো। তিলকের দিব্যদৃষ্টির এমন ক্ষমতা দেখে শ্যামাপদ মায়ের কাজ সেরেই সে তিলকের কাছে গিয়ে শিষ্য করার আব্দার পেশ করেছিল। তিলকও ভাবতে পারেনি তার আন্দাজে বলা ভবিষ্যৎবাণী ফলে যাবে। সেও ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিল। শ্যামাপদর মুখে এমন প্রস্তাব শুনে মনে মনে খুবই খুশি হয়েছিল। আজকাল বাতের ব্যাথাটা খুবই ভোগায়। মনে মনে তাই একটা শিষ্য চাইছিল যে কিনা একটু মালিশ করে দেবে। কিন্তু তিলক সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ বললো না। পাছে শ্যামাপদ ওকে সামান্য তান্ত্রিক ভাবে! একটু গম্ভীর হয়ে বলেছিল,"দেখ বাপু, এ জিনিস সবার জন্য নয়। বাড়ি ফিরে যাও। সংসার ধর্ম পালন কর।" গুরুর ইচ্ছে নেই দেখে শ্যামাপদর রোখ চেপে গিয়েছিল। সে সংসার ছাড়বেই, তান্ত্রিক হবেই। ওর জেদ দেখে তিলক বলেছিলো, "এখনই কথা দিতে পারছি না। কিছুদিন আমার সেবা করো, যদি খুশী হই তখন নাহয় শিষ্য করে নেব।"এরপর থেকে শ্যামাপদ তিলকের নানারকমের ফাইফরমাশ খেটে দিতে শুরু করে। পুজোর ফুল তুলে আনে, রান্নাবান্না করে, রাত্রিবেলা শোবার আগে মালিশ করে দেয়। কয়েকদিন এমন করে চলার পর তিলক ভেবে দেখলো আর শ্যামাপদকে ঝুলিয়ে রেখে লাভ নেই। সেদিন রাত্রিবেলা মালিশ খেতে খেতে তিলক শিষ্যকে সুসংবাদটা দিলো। ফলস্বরূপ শ্যামাপদ আজ তেলানন্দ নাম নিয়ে বসন্তপুরে বসে সিদ্ধি খাচ্ছে!
তিলক এখানে এসে তার গুরুর থেকে চুরি করা বইগুলো ট্রাঙ্কে গুছিয়ে রাখেনি বা ধূপধুনা দেবার জন্য সাজিয়েও রাখেনি। বেশ ভালোমতন পড়াশোনাই করছে। কী করে অতুলনীয় ধনসম্পদের অধিকারী হওয়া যায়, সেই চ্যাপ্টারে এসে ও এখন আটকে আছে। বইতে থাকা নিয়মাবলী বেশ ভালোভাবেই পালন করছিল। সে গরুর গোবর নিমগাছের আগায় বাঁধা থেকে শুরু করে, মানুষের বিষ্ঠা মধুর সঙ্গে সরিষার তেলে মাখিয়ে পুড়িয়ে সেই ধোঁয়া অমাবস্যার রাতে ঘ্রান নেওয়া পর্যন্ত সবই অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। আর তারই ফলস্বরূপ হিসেবে আজকের এই দেবীদর্শন।
স্নান, ধ্যান, প্রাতঃকৃত্য সবকিছু সেরে তিলক যখন ঘরে ফিরলো তখন তেলু পুজোর ডালি সাজাতে ব্যস্ত। গুরুর দিকে শ্রদ্ধামিশ্রিত চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,"প্রভু, দেবী মা স্বপ্নে দেখা দিয়ে কী বললো?"
-আমি দেখলাম, মা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, "বেটা কী চাস মায়ের কাছে? এত করে ডাকছিস কেন?" আমি বললাম, সবই তো জানো মা। তবে ছলনা করছো কেন? মা একটু মুচকি হেসে বললো, জানি রে পাগলা, জানি। সন্তানের দুঃখ কি আর মা জানবে না? যা চাইছিস তাই পাবি। কিন্তু তার জন্য তোকে যে অনেক পরিশ্রম করতে হবে? আমি যা চাইবো তাই তোকে দিতে হবে।
আমি তো তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "কী চাও মা। মায়ের আদেশই যদি ছেলে পালনই না করতে পারে সে ছেলের মা বলার কোনো অধিকার নেই। আর আমার এতদিনের সাধনারও মূল্য নেই।"
আমার কথা শুনে আবার মুচকি হেসে মা বললো,"তুই যদি এখন থেকে প্রতি অমাবস্যার রাতে আমায় নররক্তে স্নান করিয়ে পুজো করতে পারিস তবে একশো অমাবস্যার রাতের পর, তুই যা চাইবি তাই পাবি। তবে মনে রাখিস, নররক্ত হওয়া চাই কিন্তু।" এই বলে মা প্রস্থান করলেন।
তেলু অবশ্য জানতো না বাবাজী ঠিক কী বর পাবার আশায় এত কষ্ট স্বীকার করছেন। তাই জিজ্ঞেস করলো, "প্রভু, একশো অমাবস্যার পর কী বর পাবেন?"
পাছে শিষ্য আগে সাধনায় সফল হয়ে যায় সেই ভয়ে তিলক বললো,"সে অনেক কঠিন ব্যাপার স্যাপার। তুই আগে সাধারণ জিনিসগুলো শেখ। নাহলে এসব জানলে বড় অনিষ্ট হবে। তোর জ্ঞানভান্ডার পূর্ণ হলে আমিই তোকে সব জানাবো।"
তারপর খানিক ভেবে নিয়ে তিলক জিজ্ঞেস করলো,"আচ্ছা তেলু, এখন নরবলির জন্য মানুষ কোথায় পাই বলতো?"
তেলু সোৎসাহে বললো," ও ঠিক জোগাড় হয়ে যাবে। মানুষ বই তো নয়। গরু ছাগল হলে অবশ্য সমস্যা ছিল।"
তারপর মনে মনে খানিক হিসাব কষে নিয়ে তেলু জিজ্ঞেস করলো,"কিন্তু প্রভু, সমস্যা তো অন্য জায়গায়। একশো অমাবস্যা মানে প্রায় আট বছর। শেষে দেবী মা কথা রাখবেন তো? মানে ধরুন, উনি যে আপনাকে কথা দিয়েছিলেন তা বেমালুম ভুলে গেলেন।"
তিলক রেগে গিয়ে শিষ্যকে ভর্ৎসনা করে বলল,"ছিঃ, তেলু। মাকে নিয়ে এমন বিটকেল রসিকতা করতে তোর লজ্জা করলো না?" তারপর আপনমনে তিলক বলে উঠলো,"মা, তেলুকে ক্ষমা কর মা। না জেনে ও ভুল বলে ফেলেছে।"
তিলক জিভ বের করে কান টান মলে নিলেও, কথাটা শোনার পর তিলকও একটু দমে গেছিলো। এতক্ষন তো এতটা ভেবে দেখেনি। স্নান সেরে ধ্যান করার সময় তো ও ভাবছিল, বর পেয়ে কোনখানে জমি কিনবে, কী ব্যবসা খুলবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আট বছরের গল্প শুনে এখন সে একটু হতাশ হলো বৈকি।
কিন্তু নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্যই হোক কিংবা তেলুকে উৎসাহ দেবার জন্যই হোক, তিলক বললো," কষ্ট না করলে কী আর কেষ্ট মেলে রে?"
তো ওইদিন টাকাপয়সা, জমিজায়গা, নরবলি ইত্যাদির কথা ভাবতে ভাবতেই কেটে গিয়েছিল। কিন্তু দিনদুই পরে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসেই তিলকের মনে নানারকম চিন্তার উদয় হল। নরবলি দিতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তারপর তার যে কী দশা হবে তা ভেবেই এখন থেকে তার হাতপা কাঁপছে। তারপর এত মানুষই বা জোগাড় করে কোথা থেকে। একশ মানুষ জোগাড় করা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়? মানুষ তো আর নিমপাতা, কিংবা জবাফুল নয় যে গেলাম আর নিয়ে এলাম। তার উপর এটা এখন একবিংশ শতাব্দী। লোকজন আর আগের মত ভয়ও করে না তান্ত্রিকদের। বরং কেমন সন্দেহের চোখে দেখে। এরকম করে আট বছর চালাতে হবে?
ভাবতে গিয়েই তিলক উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। অনেক ভেবে তিলক এক ফন্দি আঁটল। আচ্ছা, মাকে রিকোয়েস্ট করলে যদি কিছু কনসেশন পাওয়া যায়! মানে ধরা যাক মা একশো থেকে একটা শূন্য বাদ দিয়ে দশটা নরবলিতে রাজি হলো। কিংবা নরবলিটা যদি পাঁঠাবলিতে ট্রান্সফার করা যেত! তাহলে অনেক ঝামেলা কমে যেত।
সন্ধ্যেবেলা গুরুর মুখে এই কথা শুনে তেলু অবাক হয়ে বললো," প্রভু, আপনি কি পাগল হয়েছেন? দেবী মার সঙ্গে দরদাম করছেন? একি বাজারে আলু পটল কিনতে গেছেন নাকি? একশো থেকে একেবারে দশ! নরবলি থেকে একেবারে পাঁঠাবলি?"
তিলক আমতা আমতা করে বললো," মাকে হাতেপায়ে ধরে অনুরোধ করলে মা কি আর সে অনুরোধ রাখবে না ? ছেলেকে কি আর মা ফিরিয়ে দেবে? তেমন ভক্তি শ্রদ্ধা করে মাকে ডাকা চাই।"
তিলক মুখে একথা বললেও মনে ঠিক জোর পেলনা তেলুর কথা শুনে। তেলু বলে চললো," বর্তমানে দেশের যা অবস্থা, তাতে মানুষের চেয়ে পাঁঠা জোগাড় করা বেশী শক্ত কাজ। এত পাঁঠা পাবেন কোথায়। হয় পাঁঠা চুরি করতে হবে নয়তো কিনতে হবে। পাঁঠা চুরি করে ধরা পড়লে আর রক্ষে নেই। মানুষকে তবু ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আসা যায়। কিন্তু পাঁঠা? আর কিনতে গেলে তো কথাই নেই। প্রতি পাঁঠা গড়ে তিনহাজার করে ধরলেও একশো পাঁঠার পেছনে কত যায় তা একবার হিসেব করে দেখেছেন প্রভু?"
তিন লাখ! হিসাব করতে গিয়েই তিলকের পিলে চমকে উঠলো। শিষ্যের সামনে এরকম ঘাবড়ে যাওয়াটা ভালো দেখায় না। তাতে আর গুরুর মান থাকে না। তিলক তাই জোর করে নিশ্চিন্ত থাকার ভান করে বললো,"ওসব কোনো ব্যাপার হলো। গ্রামে গিয়ে ওদের ভালোর জন্য বলি দিচ্ছি বললে ওরা নিজেরাই বাড়ি বয়ে পাঁঠা দিয়ে যাবে। সবই মায়ের ইচ্ছা রে তেলু!"
তেলু যেন আজ সমস্যার প্রতিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বললো," আচ্ছা সবকিছুর পর যদি বর না পাওয়া যায়, কিংবা যদি মা বলেন তেইশ নম্বর পাঁঠাটা রোগপটকা ছিল, অসুখ ছিল। অসুস্থ পাঁঠা দিয়ে পুজো করায় মা যদি বলে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে, তখন কী হবে একবার ভেবে দেখেছেন?"
তেলুর কথা যত শুনছে ততই তিলকের নিজের উপর থেকে আস্থা কমে যাচ্ছে। তেলুর কথাগুলোর মধ্যে যে যুক্তি নেই তা কিন্তু নয়। তবুও মনকে শক্ত করে তিলক বললো," আরে মায়ের কথা বেদবাক্য। সে কথার নড়চড় হয় না রে তেলু।"
তেলু না থেমেই বললো," সে নাহয় বুঝলাম। মা খুশি হয়ে বরও দিল আট বছর পর। কিন্তু নরবলির বদলে পাঁঠাবলি দেবার জন্য বরের মাত্রাটা কমিয়ে দিলো। যেমন ধরেন, আপনি হয়তো চাইছেন অমর হতে। মা হয়তো অমর থেকে অ বাদ দিয়ে দিল। কিংবা ধরুন চাইছেন টাকা পয়সা, মা হয়তো টাকা বাদ দিয়ে শুধুই দিল অচল পয়সার বর।"
তিলক চিন্তান্বিত হয়ে বললো,"মাকে অবিশ্বাস করছিস তেলু? তোর ভালো হবে না।"
তেলু আবার জিভ কেটে কান মলে বললো,"আমার অবিশ্বাসে কি যায় আসে বলুন? আমি তো আর বর চাইছি না? কিংবা আমি নিজে পূজাও করছি না।"
তিলক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,"যাই উঠি এখন। একটু মায়ের ধ্যান করতে হবে। মনটা বিচলিত আছে।"
তিলক প্রতিরাত্রে স্বপ্নে মাকে কামনা করতে লাগলো কনসেশনের কথাটা বলবে বলে। কিন্তু মা আর দেখা দেয় না। আট দশদিন এভাবে চেষ্টা করার পর অবশেষে মায়ের দেখা মিলল একদিন। তিলকের আব্দার শুনে মা যারপরনাই কুপিত হলেন। বললেন," ওরে নরাধম, তুই মায়ের সাথে এসছিস দরদাম করতে? কনসেশন চাইছিস মূর্খ? আমাকে নররক্তের বদলে পাঁঠার রক্তে স্নান করাতে চাস? এতবড় আস্পর্ধা?"
মায়ের কথা শুনে তিলক তো ভেউভেউ করে কেঁদে উঠল। ভোরবেলা তাই ঘুম থেকে উঠে তিলক চিন্তিত মুখে বসে রইলো। তার নিজের গালেই নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছা হলো। কী যে দুর্বুদ্ধি চেপেছিলো মাথায়? না, এই হতভাগা তেলুকে আর সঙ্গে রাখা যাবে না। ওর জন্যই এত সমস্যা হচ্ছে। নইলে তো এত চিন্তাও ছিল না। কিন্তু তারপরই যখন বাতের ব্যাথ্যাটার কথা মনে পড়লো তখন তিলক মনে মনে বললো,"এইবার ওকে ক্ষমা করলুম। এর পরেরবারে বিদায় করে দেব।"
তেলুর ব্যাপার নিয়ে নাহয় পরে ভাবা যাবে। তার জন্য হাতে ঢের সময় আছে। কিন্তু ওদিকে মা যে মাত্র একটা অমাবস্যা টাইম দিয়েছে। ওর মধ্যে নররক্ত দিয়ে পুজো শুরু না করলে এ জীবনে সে আর মায়ের দেখা তো পাবেই না, উল্টে তার সর্বনাশ হবে। তিলক এখন পড়েছে উভয়সঙ্কটে। না পারছে পুজো দিতে, না পারছে পুজো বন্ধ করে দিতে।
সব দেখেশুনে তেলু গুরুকে সাহস যোগাতে লাগলো। কিন্তু তিলকের আর পুজোয় তেমন আগ্রহ নেই। ধ্যানেও বসে না। ঠিক করে খাওয়াদাওয়া করে না। সবসময় চিন্তান্বিত মুখে বসে থাকে। কথাবার্তাও ঠিকঠাক বলে না।
এখন তো আর সেই আগের দিনকাল নেই যে চারিদিকে বনজঙ্গল। তার মধ্যে কোথাও লুকিয়ে নরবলি দিলে কেউ জানতেও পারবে না। এখন ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। খামোকা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ফাঁসিতে লটকে যাবার কোনো ইচ্ছা এখন তিলকের নেই।
দেখতে দেখতে একটা অমাবস্যা প্রায় চলে এলো। ওদিকে তেলানন্দ কিন্তু গুরুর মতন বসে নেই। এরই মধ্যে কোথা থেকে এক ধারালো খড়্গ নিয়ে এসে গুরুর হাতে তুলে দিয়েছে। তিলক হাতে তুলে একবার সেটা দেখে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উপরে তুলে রাখলো। একদিন পর বিকেলবেলা তেলু কোথা থেকে একটা ছয় সাত বছরের নধর বালককে সঙ্গে নিয়ে হাজির করলো তিলকের সামনে। বালককে দেখে তিলকের ভয়ে প্রান উড়ে গেল। তেলানন্দ একেই বলি দিতে নিয়ে এসেছে নাকি? ছেলেটাকে দেখেই তিলক ইতিমধ্যে ভেবে নিয়েছে কী কী সমস্যা হতে পারে এরপর। সব যেন চোখের সামনে ভাসছে। ওই ছেলেটির বাাড়ির লোকজন নিশ্চয় এতক্ষনে থানায় চলে গেছে ডায়েরি করতে। পুলিশ হয়তো খোঁজাখুঁজিও শুরু করে দেবে। এসব ভাবতে গিয়েই তিলকের হাত পা কাঁপতে লাগলো।
তেলু গুরুকে সাহস দিয়ে বললো,"ভয়ের কিছু নেই প্রভু। প্রথম প্রথম এইরকম হয়। তারপর দেখবেন ভয় কেটে গেছে। তখন বলবেন এর চেয়ে সহজ কাজ আর কিছু হয়না। আপনি খড়্গটা হাতে ধরে দাঁড়িয়ে থাকবেন। হাঁড়িকাঠে ছেলেটার মাথা ঢোকানো থাকবে। আমি ওয়ান টু থ্রি বলবো, আপনি চোখ বুজে জয় মা বলে কোপ লাগাবেন। দেখবেন কী সুন্দরভাবে বলি দেওয়া হয়ে গেল। ঠিক করে হয়তো টেরই পাবেন না।"
তেলু এমনভাবে কথাগুলো বললো, যেন নরবলি দেওয়া ডালভাত খাওয়ার মতো সাধারণ জিনিস। তিলক মনে মনে ভয়ানক চটে গেল তেলুর উপর। মনে মনে রামছাগল, উল্লুক, পাঁঠা বলে গালাগালি করতে লাগলেন। অবশ্য তিলকও প্রথমে নরবলি দেওয়াটা খুব সাধারণ কাজ বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু এখন বুঝতে পারছেন তার দ্বারা এটা হয়ে উঠবে না। তিলক তেলুকে বললো, "বাবা তেলু, যার বাড়ি থেকে ছেলেটাকে নিয়ে এসেছিস তার বাড়িতে ওকে ফেরত দিয়ে আয়। নইলে আর একটু পরে ওরা থানায় যাবে। আর তারপর আমাদের দুজনের কোমরে দড়ি বেঁধে ধরে নিয়ে যাবে। আর বলি দিয়ে কাজ নেই।"
তেলানন্দ আবার ছেলেটিকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে তিলক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
রাত্রিবেলা বিছানায় শুয়ে এটা ওটা নানারকম কথা ভাবতে ভাবতে হটাৎ করে তিলকের কী একটা কথা মনে পড়ে গেল। আর তারপরই তিলক বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে নাচানাচি শুরু করলেন। সঙ্গে হোহোহো করে অট্টহাসি হাসতে লাগলেন। তেলানন্দ সবে আরাম করে শুয়েছিল। গুরুর কান্ড দেখে ছুটে এলো সে।
-প্রভু শান্ত হোন। পাগল হয়ে গেলেন নাকি?
তিলক নাচতে নাচতে বলতে লাগলো,"কী বোকা! আমি কী বোকা! এত সহজ জিনিসটা আমি কেন কঠিন করে ভাবছি?"
তেলু বললো,"আমি তো বলেইছিলাম, নরবলি দেওয়াটা তেমন কঠিন কাজ নয়।"
তিলক একটুখানি স্থির হয়ে বসে হেসে বললো বলল," আরে তা নয়। তেলু, মা আমাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছিল যে তাকে নররক্তে স্নান করিয়ে পুজো করতে হবে।"
-হ্যাঁ, সে তো জানি।
-কিন্তু মা তো এটা বলেনি, যে নরবলি দিতেই হবে।
-তার মানে? নরবলি ছাড়া নররক্তে মাকে স্নান করাবেন কী করে?
-তেলু, তুই একটা আস্ত গবেট। নরবলি ছাড়া কী আর রক্ত পাওয়া যায় না? আজকাল ব্লাড ব্যাংক না কীসব হয়েছে কী জন্য? তাছাড়া রক্তের বন্যা বইয়ে দিতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। একটুখানি রক্ত দিয়ে মাকে মুছিয়ে নিলেই হলো!
-তাহলে কালকের পুজোর কী হবে?
- কাল তোকে দিয়ে কাজ চালিয়ে নেব। পঞ্চা ডাক্তারকে কাল ডেকে আনবি। সেই এসে কিছু রক্ত টেনে বের করে নেবে।
তেলানন্দ হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইলো। তিলকানন্দ গদগদ হয়ে বললো,"সকলি তোমারই ইচ্ছা মা!"
✍️✍️✍️
আমার কথা: অন্যান্য গল্পের পাশাপাশি আমার সবচেয়ে বেশী ভালো লাগে হাসির গল্প লিখতে। সেই ভালো লাগা থেকে আজ থেকে সাত আট বছর আগে স্কুলে পড়ার সময় লিখি এই গল্পটা। এতদিন পর সেই গল্পটা সামান্য কিছু পরিমার্জন ছাড়া পুরোটাই তুলে ধরলাম।
コメント