top of page

Blog


Two-dimensional (2D) materials are a special class of materials having a wide range of applications due to their various advantages like high aspect ratio, high surface to volume ratio, improved mechanical/ optical properties, etc., than those of their bulk counterparts. After the discovery of graphene in 2004, other layered materials like hexagonal boron nitride (h-BN) and transition metal dichalcogenides (TMDC) attracted significant interest to the scientific community. Different exfoliation techniques like mechanical exfoliation, ball milling, liquid-phase exfoliation (LPE), gas-phase exfoliation, etc have been employed to obtain graphene-like nanosheets. Immediately, these exfoliated materials find their utility in a large number of applications. One of these application sectors is bioelectronics which is growing rapidly over the past few years because of its wide range of applications like sensing, point-of-care monitoring, wearable devices, implants, etc.

To use 2D materials in these applications, the processing steps have to be environment-friendly and safe. The processing solvent preferably has to be water. This is the most important criterion to use those materials in bioelectronics. However, obtaining water dispersion of 2D materials is really a challenging task since most of these materials are hydrophobic in nature. Although, there are numerous reports in the literature, describing the methods of obtaining aqueous dispersions of 2D materials. However, in most of the reports, surfactants/additives were used to obtain aqueous dispersion. This is an old-school technique to make hydrophobic material hydrophilic. Most often complete removal of surfactants is impossible which ultimately degrades the device's performance. Therefore, obtaining additive-free aqueous dispersion of 2D materials remains challenging. Recently, our paper published in Chemistry-A European Journal (10.1002/chem.202005491) solves all these problems.

Chemistry-A European Journal, 2021, 27, 7434-7443

Here, employing a simple pre-processing step makes our life easier. Firstly, h-BN and TMDC (e.g. MoS2, MoSe2, WSe2) are liquid phase exfoliated in an organic solvent. Secondly, the dispersions are dried to obtain powders which are subsequently ultrasonicated for few minutes in water to obtain water dispersion. The obtained aqueous dispersion is found to be well stable for a reasonable duration of time.

In this paper, we also studied the glial cell compatibility and enzymatic degradation of these 2D materials (h-BN and MoS2). Cytocompatibility and biodegradation studies are indispensable parts of bioelectronics because these materials should degrade automatically after finishing their intended task for a definite period of time. Also, the degradation byproduct has to be non-toxic for safe use inside the human body as well as for the environment. Biodegradation of h-BN and MoS2 has been confirmed through Raman spectra and transmission electron microscopy. Besides, it is observed that these 2D materials are safe for glial cells up to 100 μg/mL. The whole paper can be summarized through the following schematic.

Copyright © 2021 Wiley-VCH GmbH

Interested readers can go through the original publication through this link. If you wish to have a copy of this paper, please contact me.

Have a good day!

Writer's picture: Priyabrata SahooPriyabrata Sahoo

Updated: May 23, 2024



ছেলেটাকে রিয়া প্রথম দেখল পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানের পাশে। পাশ দিয়ে যাতায়াত করলেও রিয়া সচরাচর তাকায়না দোকানটার দিকে। এপাড়া ওপাড়া থেকে বহু ভাল খারাপ ছেলে, বুড়ো এসে ওখানে আড্ডা জমায়। তারপর খেলা থেকে শুরু করে রাজনীতি, সিনেমা, খুনখারাপি, এমনকি ধর্ষণ পর্যন্ত তাদের আলোচনা গড়ায়। দোকানের দিকে না তাকালেও, দোকান অতিক্রম করার সময় যে আট-দশ সেকেন্ড লাগে, তাতেই ওদের কথাবার্তা শুনে বোঝা যায় কিসের আলোচনা চলছে। একদিন তো রিয়ার গা ঘিনঘিন করে উঠেছিল, একজনকে ধর্ষণকে জাস্টিফাই করে নিজের মতামত দিতে দেখে। বেশি নয়, মাত্র দু লাইন শুনেই বুঝে গিয়েছিল কোন মহান আলোচনা চলছে। তার উপর পাশ দিয়ে কোন মেয়ে গেলেই ছেলেছোকরার দল হাঁ করে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন জীবনে কোনদিন মেয়েই দেখেনি। তাই পারতপক্ষে জায়গাটা দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে যায় সে। ছেলে বুড়োদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাঁচার ওটাই সবচেয়ে সহজ পথ। একদিন ওই চায়ের দোকানেই বসে সিগারেট খাচ্ছিল একটা ছেলে। ছেলেটাকে আগে দেখলেও জানাশোনা নেই। রিয়াকে আসতে দেখে অনেক দূর পর্যন্ত পিছু নিয়েছিল ওর। সেদিন দ্রুত সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে গেলেও ঝামেলা থেকে সে মুক্তি পায়নি। এর ঠিক কয়েকদিন পর, সেই ছেলেটাই গোলাপ ফুল নিয়ে এসে রাস্তার মাঝে পথ আটকে রিয়াকে প্রপোজ করে। রিয়া মুখে কিছু না বলে ফুলটা হাতে নিয়ে রাস্তার পাশে ছুঁড়ে দেয়। তারপর কোনো কিছু না বলেই সাইকেলে উঠে এক নিঃশ্বাসে বাড়ি ফিরেছিল সে। বাড়ি পৌঁছেও বুকের ধুকপুকুনি যেন কিছুতেই থামতেই চায়না ওর। সেদিন এক অজানা ভয় যেন তাকে ঘিরে ধরেছিল। এমন নয় যে, এই প্রথম তাকে কেউ প্রপোজ করলো। কিন্তু ইদানীং তার মনে কিছু ভয় এসে গেছে নিজের অজান্তেই। আজকাল রাস্তাঘাটে কোনো ছেলে গোলমাল পাকানোর চেষ্টা করলেই ভয়টা তীব্র হয়ে উঠে। সেদিনও তাই ঘটলো। গোলাপফুল ছুঁড়ে দিয়েছে দেখে যদি আরও ছেলে টেলে নিয়ে চড়াও হয় ওর উপর? ছেলেটাকে কেমন গুন্ডা গুন্ডা দেখতে। আজকাল খবরের কাগজ খুললেই যা সব দেখতে পাওয়া যায়! তার উপর গানের ক্লাস সেরে ফিরে আসার রাস্তা ওই একটাই। গোদের উপর বিষফোঁড়া হিসেবে চায়ের দোকানের আগে এবং পরে বেশ কিছুদূর পর্যন্ত রাস্তাটা নির্জন। দুই-একটা ঘর অবশ্য আছে বটে, তবে চিৎকার করলে সাড়া পাওয়া যাবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সেদিনের ঘটনাটা তেমন কিছুই নয়। তবুও ওই ঘটনার পর সে দুইদিন গানের ক্লাসে যায়নি। মাকে অবশ্য মিথ্যা বলেছিল। গানের দিদি কয়েকদিন থাকবে না, বাইরে কোথায় একটা বেড়াতে যাবে।মা অবশ্য গানের দিদিকে চেনে না, তাই সত্য মিথ্যা যাচাই করার প্রশ্নই নেই। সেদিক দিয়ে সে নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু সমস্যা হল ছেলেটা দুদিন পরেও যদি ঝামেলা পাকায়? অ্যাসিড অ্যাটাক, ধর্ষণ কত সব ঘটে যাচ্ছে চারিদিকে। কোন পাড়াই আর যেন নিরাপদ না।রিয়া যেদিন থেকে সত্যিকারের "মেয়ে" হয়ে উঠেছে সেদিন থেকেই ছেলেরা আড়চোখে তাকাতে শুরু করেছে। মাঝেমধ্যে সাইকেলে যাবার সময় রাস্তায় উল্টোপাল্টা কথাও বলতে শুনে। কিন্তু সে এতটা সাহসী নয় যে তেড়ে গিয়ে ওদের সঙ্গে ঝগড়া করবে বা মুখের উপর জবাব দিয়ে আসবে। তাই চুপচাপ সব কিছু হজম করে চলে আসে। তার উপর লাজুক স্বভাবের হবার জন্য সব কথা মা কিংবা বন্ধুদের বলতেও পারে না। এই যেমন প্রপোজ করার ঘটনাটা। অনেকবার চেষ্টা করেও মাকে মুখ ফুটে বলতে পারেনি। এমনকি বন্ধুদেরও না। কিছু বলতে গেলেই কে যেন তার জিভটাকে টেনে ধরে থাকে। অথচ ওর বান্ধবীদের কেউ প্রপোজ করলে তারা নিজেরাই বুক ফুলিয়ে এসে সবাইকে শোনায়। অথচ সে নিজে তাদেরকে সব কথা বলতে পারেনা। তাই নিজের সমস্যাগুলো নিজের মতো করেই মিটিয়ে নেবার চেষ্টা করে। অবশ্য রিয়ার দুই তিনজন ক্লোজড ফ্রেন্ডও আছে। টিউশন বা কলেজে গেলে তাদের সঙ্গেই সবসময় থাকার চেষ্টা করে। ছেলেদের ভিড় এড়িয়ে চলে। শুধুমাত্র এই গানের ক্লাসে একা যেতে হয়। মন্দের ভালো হিসেবে, গানের ক্লাসটা সন্ধের আগেই শেষ হয়ে যায়। নইলে খুব সমস্যায় পড়তে হতো ওকে। যাইহোক, দুদিন পর মনে অনেক ভয় নিয়েই রিয়া গানের ক্লাসে গেল। সেদিন ছেলেটাকে রাস্তায় কোথাও দেখতে না পেয়ে সে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এরপর দু একবার রাস্তায় ছেলেটার সঙ্গে দেখা হলেও, ছেলেটা আর ওকে বিরক্ত করেনি। সেদিক দিয়ে ছেলেটাকে বেশ ভালো বলতেই হবে গুন্ডা টাইপের হলেও একেবারে গুন্ডা নয়। অন্যের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে দাম দেয়।

কিন্তু আজ ফেরার পথে চায়ের দোকানের দিকে আপনা আপনি চোখ চলে গেল রিয়ার। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ দোকানে ভিড় কম বলেই মনে হচ্ছে। সেই জন্যই হয়তো ওর নজর চলে গিয়েছিল। তাছাড়া ছেলেটার দিকে চোখ যাবার আরো একটা কারণ হলো, ছেলেটা দোকানের বেঞ্চিতে না বসে পাশে থাকা একটা বটগাছে হেলান দিয়ে সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। একেবারে সিনেমার হিরোর স্টাইলে। মেয়েদের একটা নিজস্ব ক্ষমতা আছে। মেয়েরা একবার চোখ বুলিয়েই অনেক কিছু বুঝে নিতে পারে, অনেক কিছু দেখে ফেলতে পারে। এই যেমন রিয়া, এক পলকের বেশি তাকায়নি সে ছেলেটার দিকে। কিন্তু তারই মধ্যে যা দেখার, সে দেখে নিয়েছে। ছেলেটার পরনে রয়েছে নেভি ব্লু কালার জিন্স এবং একটা কার্টুনের ছবি দেওয়া সাদা রঙের টি-শার্ট। চোখে রয়েছে ব্ল্যাক ফ্রেমের চশমা। পায়ে একটা শু।দেখতে মোটামুটি ফর্সাই। যদিও অনভিপ্রেত কিছু ঘটেনি, কিন্তু কেমন যেন রিয়ার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠেছিল। নাহ, প্রথম দেখায় প্রেমে সে পড়েনি, নতুন করে অজানা ভয়টা ঘিরে ধরেছিল। যদিও সে জানে ভয়টা অমূলক। ছেলে মানেই তো আর রাক্ষস না। তাছাড়া রাস্তায় কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেই যদি ভয় পেতে হয় তবে তো ঘর থেকে না বেরোনোই ভালো। কিন্তু সবসময় কি আর যুক্তি দিয়ে সবকিছুর ব্যাখ্যা হয়? রিয়া বুঝতে পারলো, ছেলেটার দিকে তাকানোটা ঠিক হয়নি। যদিও ওটাকে ঠিক তাকানো বলে না। একবার তাকিয়েই আবার মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। কয়েক মিলিসেকেন্ড হবে হয়তো। কিন্তু ছেলেটা কি বুঝতে পেরেছে ওর তাকানোটা। মনে তো হয়না। আসলে আজকালকার ছেলেগুলো ভীষণ বজ্জাত। একবার তাকালেই, হেসে কথা বললেই ভেবে নেয় যে সে বুঝি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। চিন্তাটা সেইজন্যেই। ও যে তাকিয়ে দেখেছে, সেটা যদি ছেলেটা বুঝতে পারে এবং সেটাকে যদি গ্রিন সিগন্যাল ভাবতে শুরু করে তাতেই সমস্যা। আরো কয়েকজন ছেলে থাকতে শুধুমাত্র ওর দিকে তাকানোটাই যদিও সে অন্যভাবে নেয়? এরকম আরো কিছু ভুলভাল চিন্তা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। এটা তার একটা বাজে স্বভাব। অতিরিক্ত এবং অনর্থক চিন্তা করায় তার জুড়ি নেই। দোকান ছাড়িয়েছে সে এখন অনেকদূর চলে এসেছে। কিন্তু ভাবনাগুলো কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছে না। ছেলেটাকে এর আগে এই পাড়ায় দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। সেইজন্য আরো কিছু দুশ্চিন্তা তার মাথায় চেপে বসল। কেউ ছেলেটাকে চেনে না, এটাই তো সুবিধা। অপরাধ করে যদি পালিয়ে যায় কেউ তখন ধরতে পারবেনা। কিংবা যদি একদিন ফাঁকা রাস্তায় ― "আরে আরে আরে! রাস্তার ডানদিক বাঁদিক দেখে সাইকেল চালাবে তো না কি? অন্ধের মত কেমন সাইকেল চালাচ্ছে দেখো?" একজন মাঝবয়সী লোকের মুখে এই কথা শুনে তার সম্বিত ফিরল। সামনে তাকিয়ে দেখল, নিজের অজান্তেই সে ব্রেক না চেপে ধরলে, লোকটাকে সত্যিই জোর ধাক্কা দিত। বিপদ বুঝতে পেরে লোকটা ডানদিকে না চলে গেলে বেশ সমস্যা হতো। নিজের অজান্তেই রিয়া কখন যে রাস্তার ডানদিকে চলে এসেছিলো তা সে বুঝতেই পারেনি। "স্যরি কাকু! দেখতে পাইনি। একটু তাড়া ছিল।"- এই বলে সে সাইকেল না থামিয়েই চলে এসেছিল। লোকটা যদিও এরপর গজগজ করে কিছু বলছিল বটে, কিন্তু তা আর রিয়ার শোনা হয়ে উঠেনি।

মন খুবই জটিল জিনিস। এই তো কিছুক্ষণ আগেই কত দুশ্চিন্তা তাকে ঘিরে ধরেছিল। কিন্তু এই যে দুজনের সাইকেলে সাইকেলে "প্রায় ধাক্কা" লাগলো, তাতেই রিয়ার সব চিন্তাগুলো পথ হারিয়ে ফেললো। উল্টে, খানিক আগের চিন্তাভাবনাগুলো খেয়াল করতেই তার বেশ হাসি পেল, হালকা লজ্জাও অনুভূত হলো। খুবই সাধারন একটা ব্যাপার নিয়ে ও যে কবে গভীরভাবে ভাবা বন্ধ করবে সেটাই বরং ভাববার বিষয়। এইসব চিন্তা করতে করতেই না শেষে ও পাগল হয়ে যায়! বাড়ি ফিরে অন্যান্য কাজের মধ্যে থেকে ছেলেটার কথা বেমালুম ভুলে গেলো সে।

দুদিন পর বুধবারে আবার গানের ক্লাসে গেল সে। গানের ক্লাস সপ্তাহে তিনদিন করে হয়। রবি, বুধ, আর শুক্রবারে। এমনিতে দুদিন করেই ক্লাস হয়। কিন্তু এখন কলেজ ছুটি আছে বলে রিয়া তিনদিন করে যায়। বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে একটু বাইরে থেকে ঘুরে এলে মনটাও বেশ ভালো থাকে। তার উপর গানের দিদির সাথে গানের ফাঁকে ফাঁকে আড্ডাও হয়। বয়সে দিদি প্রায় বছর দশেকের বড় হলেও রিয়ার সাথে বন্ধুর মতো করে মেশে। আজ হলুদ রঙের একটা চুড়িদার পরেছে ও। রিয়া এমনিতে মোটামুটি ভালই দেখতে। তার উপর হলুদ ড্রেসে আজ ওকে বেশ ভালো লাগছে। মেকআপ সাধারণত ও করে না, বলা ভালো পছন্দ করে না। মুখে এমনিতেই একটা শ্রী ভাব আছে। খামোকা মেকআপ দিয়ে সেটাকে ঢেকে দেওয়ার কোনো মানে হয়না। আজ দিদি তার প্রেমিকের হাত ধরে প্রথমবারের মতো দীঘা বেড়াতে যাবার গল্পটা ওকে বলছিল। আসলে দীঘায় গিয়ে বেশ মজার একটা ব্যাপার হয়েছিল। অনীকদা, মানে দিদির সেই প্রেমিক কিছু একটা আনতে দোকানে গিয়েছিল। দোকানে ভিড় থাকায় অনীকদার ফিরতে দেরি হচ্ছিল। তার উপর অনীকদা গেল টয়লেটে! ওদিকে দিদি অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে অনীকদাকে খুঁজতে বেরোয়। তারপর একে অপরকে প্রায় আধঘন্টা ধরে খুঁজেই চলে তারা। তখন দুজনের কাছে মোবাইল ছিল না যে ব্যাপারটা সহজ হয়ে যাবে। অবশেষে দুজন দুজনকে খুঁজে পায় বিচের কাছে এসে। বাড়ি ফেরার পথে সেইসব ভাবতে ভাবতে রিয়া নিজের মনেই হাসছিল। আহা, তারও যদি এমন কেউ থাকতো, তার সঙ্গেও যদি এমনি করেই মজার ঘটনা ঘটত! হঠাৎ দোকানের সামনে এসে পড়ায় সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে দেখল সে। হ্যাঁ, সেই ছেলেটাই। আজও সেই একই ভাবে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তবে হাতে আজ আর সিগারেট নেই, হয়তো খানিক আগে শেষ করে ফেলেছে। গাছে হেলান দিয়ে দু হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কিছু ভাবছে। গায়ে রয়েছে হলুদ রঙের টি-শার্ট। হলুদ রং!চমকে উঠল রিয়া। দ্রুত নিঃশ্বাস পড়ছে ওর। এমন আশ্চর্য সমাপতন? ছেলেটা কি রিয়াকে ক্লাসে যাবার সময় দেখেছিল? চুড়িদারের সঙ্গে রং মিলিয়ে ছেলেটা টি-শার্ট পরে আসেনি তো? কই, যাবার সময় তো ছেলেটাকে আশেপাশে কোথাও দেখেনি সে। এইসব ভাবতে ভাবতে সে পাশ কাটিয়ে চলে এলো। ছেলেটার দিকে মুখ না ঘুরিয়েই বুঝতে পারল ছেলেটা ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। কি হ্যাংলা ছেলে রে বাবা! তার উপর মুখে রয়েছে হালকা হাসি। তাই দেখে রিয়ার মনটা এবার বড়ই বিচলিত হয়ে পড়ল। যদিও কিছু ঘটেনি তবুও কেন জানি ওর মনটা কুডাক ডাকতে লাগলো। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে কিছু একটা বাজে ব্যাপার ঘটবেই। আগের মতোই এবারও মনকে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করলো রিয়া। ও মোটেও বিশ্বসুন্দরী না। পাড়ায় ওর চেয়ে ভালো দেখতে অনেক মেয়েই আছে। তাদের ছেড়ে ওর সঙ্গেই বা ছেলেটা কিছু করার চেষ্টা করবে কেন? ওই যদি সব ছেলের প্রথম পছন্দ হতো তবে আজ পর্যন্ত এমন অনেক লাভ লেটার, প্রপোজাল পেয়ে যেত। আজ পর্যন্ত সাকুল্যে দুইটামাত্র ছেলে প্রপোজ করেছে তাকে, যেখানে তার কিছু বান্ধবীর ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা পনেরো কুড়ি! এইসব বলে নিজেকে খানিক সান্ত্বনা দিল রিয়া। তাতে কিন্তু আশ্চর্য ফল হলো। এতক্ষণ যে টেনশন বা ভয়টা ছিল তা এক নিমেষেই কেটে গেল। কোন মানে হয় এসব উল্টোপাল্টা ভাবার? যত্তসব ভুলভাল চিন্তা। এসব চিন্তা থেকে আরও অনেক দরকারি চিন্তা যে রয়েছে তা যেন রিয়ার মনেই থাকে না। এই যেমন, গানের ক্লাসে পিচটা কোনোদিনই পারফেক্ট হচ্ছে না। যতবারই গান করে ততবারই দিদি ভুল ধরিয়ে দেয়। সুর, তালেও খামতি আছে। ওগুলো নিয়ে একটু খাটতে হবে। নিজের শখের বশে গানটা শিখলেও, খামতিগুলো রেখে দেওয়াটা তো কোন কাজের কথা না।

গানের ক্লাসে যাবার সময় আজ ও পুরো রাস্তাটাই ভাল ভাবে লক্ষ্য করে যেতে লাগলো। খুব সতর্ক হয়েই সাইকেল চালাতে লাগলো ও। আজ পরেছে একটা বেশ পুরনো জামা। ইচ্ছে করেই পরেছে। যতটা সম্ভব সাদাসিধা এবং খারাপ লুক নিয়ে আজ ও যেতে চায়।ওই তো! দূর থেকে দোকানের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল রিয়া। ঠিকই চিনেছে। ছেলেটা আজ দোকানের বেঞ্চিতে বসে আছে। সেই একইভাবে হাতে জ্বলছে সিগারেট, পরনে রয়েছে বারমুডা। ওকে দেখতে পেয়েই হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল রিয়ার। এর আগে ক্লাসে যাবার সময় কোনদিন ছেলেটাকে সে দেখতে পায়নি, সবসময় দেখেছে ফেরার সময়ই। তবে আজ কী হলো? ছেলেটা কি খোঁজ নেবার চেষ্টা করছে? সে কখন ক্লাসে যায়, কখন ফেরে, এইসব? রিয়া আড়চোখে তাকিয়ে দেখল ছেলেটা ওর দিকে স্রেফ হাঁ করে তাকিয়ে আছে এবং সম্ভবত ওকে দেখতে পেয়েই মুখ থেকে সিগারেটটা নামিয়ে রাখল। দ্রুত সাইকেল চালিয়ে ছেলেটাকে অতিক্রম করে এগিয়ে গেল সে। পুরোনো ভয়টা আবার তাকে ঘিরে ধরলো। ছেলেটা তাহলে সত্যিই ওকে ফলো করছে। নইলে এইসময় এসে দাঁড়িয়ে থাকতো না। যতবারই ফলো করার কথা মনে হয় ততই অনেক হাবিজাবি চিন্তা ওর মাথায় ভিড় করে আসে। নাহ, এবার ছেলেটাকে সে জিজ্ঞেস করবে, কেন ফলো করছে প্রতিদিন? দরকার হলে দুএকটা কথাও শুনিয়ে দেবে। এইভাবে কিছু না বলার জন্য যেন পেয়ে বসেছে। একটু কঠোর হতেই হবে রিয়াকে। মুহুর্তের মধ্যেই ও মনে মনেই একটা কাল্পনিক কথোপকথন সাজিয়ে নিল।

"কী ব্যাপার বলুন তো? প্রতিদিনই দেখছি আপনি আমাকে ফলো করছেন?" "আপনার কেন এমন মনে হল বলুন তো?" মুখ থেকে হয়তো সিগারেটটা নামিয়ে ছেলেটা জিজ্ঞেস করবে। " কয়েকদিন ধরে দেখছি আপনি আমাকে নোটিস করছেন? হাঁ করে তাকিয়ে আছেন?" "আজকাল রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেলে বুঝি নোটিশ করা হয়? ফলো করা হয়?" খানিক ভেবে রিয়া বলবে, "কথা এড়িয়ে যাবেন না। আপনি আমাকে বলুন ঠিক কী কারণে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন রোজ রোজ? আমার জন্য ওয়েট করেন বলে মনে হল?" হালকা হেসে ছেলেটা বলবে, "আপনি বুঝলেন কী করে যে আমি আপনার দিকে তাকিয়ে থাকি? তাহলে আপনিও কি আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন?" এরপর কিছুক্ষণ থেমে হয়তো সিরিয়াস গলায় আবার বলবে, "যদি এত ভয়, এত সন্দেহ থেকে থাকে তবে বাড়ির মধ্যে সিন্দুকে আটকা থাকলেই হয়। বাইরে বেরোনোরই বা কী দরকার?" কথোপকথনটা এতদূর ভেবেই রিয়ার ভীষণ লজ্জা লাগলো। সত্যিই তো, কী জিজ্ঞেস করবে ওই ছেলেটাকে? কেউ শুধুমাত্র রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে বলে কিংবা তার দিকে চেয়ে থাকে বলে, তাকে সন্দেহ করে উল্টোপাল্টা কিছু বলে দেওয়া যায় না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। বিশেষত ছেলেটা যখন তার সঙ্গে কোনো কিছু খারাপ কাজ করার চেষ্টা করে নি। খারাপ কাজ তো দূর অস্ত, যেখানে সামান্য কথাবার্তাও কখনো দুজনের মধ্যে হয়নি।

ছেলেটাকে যখন কিছু বলা যাবে না তখন তার থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়। ছেলেটার কিছু বদ মতলব আছে কিনা তা না জেনে কিছু করা ঠিক না। রিয়া ঠিক করল ক্লাস শেষ হবার পর তার বান্ধবী শ্রেয়ার বাড়িতে সে যাবে। ওই একই রাস্তা দিয়ে আরো কিছুদূর এগিয়ে গেলে শ্রেয়ার বাড়ি। সেখানে ঘণ্টা দেড়েক কাটিয়ে একটু দেরি করেই আজ ও বাড়ি ফিরবে। ও দেখবে, ছেলেটা ওর জন্য দাঁড়িয়ে থাকে কিনা। যদি থাকে তবে একদম নিশ্চিত হওয়া যাবে যে ওর জন্যই ছেলেটা দাঁড়িয়ে থাকে। নইলে শুধুমাত্র সিগারেট খাওয়ার জন্য কেউ তিন-চার ঘন্টা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না বা দোকানে বসে থাকে না। অনেক ভাবনাচিন্তার পর এই প্ল্যানটাকে ওর বেশ ভালো বলে মনে হল।

ক্লাস শেষ করে রিয়া গেল স্কুলের ফ্রেন্ড শ্রেয়ার বাড়িতে। শ্রেয়া বেশ অবাক হল এই অসময়ে রিয়াকে ওদের বাড়িতে দেখে। আসলে একসঙ্গে পড়লেও ওরা দুজন এতটাও ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিল না। তার উপর এখন দুজনে দুটো আলাদা কলেজে পড়ে। যোগাযোগটাও আগের মতো নেই। তাই কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজা খুলে শ্রেয়া ভীষণ আশ্চর্যই হল। রিয়া অবশ্য হাসিমুখ করে, "কেমন আছিস, কাকিমা কেমন আছে"– বলে পরিবেশটা স্বাভাবিক করবার চেষ্টা করল। শ্রেয়াও সামলে নিয়েছে, হাসি মুখ করে হাত ধরে ঘরের মধ্যে ডেকে নিয়ে গেছে রিয়াকে। সে অবশ্য আসল কথাটা শ্রেয়াকে খুলে বলেনি। শুধু বলেছে, "এদিকেই গানের ক্লাসে আসি। তাই ভাবলাম একবার ঘুরে যাই। অনেকদিন দেখা হয়না।" শ্রেয়া অবশ্য খুব খুশিই হলো। শ্রেয়ার বাড়ি থেকে যখন ও বেরোলো তখন অলরেডি সন্ধ্যা সাতটা। প্রায় ঘন্টাখানেক এর উপরে সে আড্ডা দিয়েছে ওখানে। ওদিকে বাড়ি ফিরতে দেরী হচ্ছে দেখে রিয়ার মা-ও একবার ফোন করে খোঁজ নিয়েছে। 'বন্ধুর বাড়িতে এসেছি'- বলাতে মা তেমন কিছু বলল না। শুধু জানিয়ে দিল দেরি না করে তাড়াতাড়ি ফিরতে। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর সময় যেমন উত্তেজনা হয় ঠিক একই রকম উত্তেজনা হতে লাগলো রিয়ার। সেই চাপা উত্তেজনা নিয়েই সাইকেল চালানো শুরু করল সে। দোকানের কাছাকাছি এসেই সাইকেলের স্পিডটা কমালো। চারিদিক ভালো করে দেখে যেতে হবে। কনফার্ম হতে হবে এই গোলমেলে ব্যাপারটাকে নিয়ে। আজ ও ইচ্ছে করেই দোকানটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলো। কিন্তু না, কোথাও কেউ নেই। ছেলেটা দোকানেও বসে নেই, গাছেও হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নেই। আশেপাশে কোথাও ছেলেটার কোন চিহ্নই নেই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবার গতি বাড়ালো রিয়া। ছেলেটা ওকে ফলো করেনি। করলে নির্ঘাত আরো একঘন্টা অপেক্ষা করতে পারতো। সে টিউশনে যখন গেছে, ফিরবে তো নিশ্চয়ই। এইটুকু অপেক্ষা সব প্রেমিকরাই করে। গল্পেও পড়েছে, সিনেমাতেও দেখেছে। এমনকি নিজের চোখেও নিজের বান্ধবীদের ক্ষেত্রেও দেখেছে। এখানে তো তেমন কিছুই ঘটলো না।প্রাথমিকভাবে খুশি হলেও রিয়া যেন ঠিক স্বাভাবিক হতে পারলো না। ও আশা করেছিল ছেলেটা দাঁড়িয়ে থাকবেই। শুধু আশা নয়, মনে মনে একপ্রকার নিশ্চিত ছিল। কিন্তু সেই ধারণাটা ভুল প্রমাণ হতে ওর কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগলো। ওর বারবার মনে হতে লাগলো, ছেলেটার অপেক্ষা করা উচিত ছিল। খুশি হবার বদলে কেমন একটা বিরক্তির আভাস দেখা দিলো ওর চোখে মুখে। ছেলেটা যে ওকে ফলো করছে না, সেই কথাটাই যেন রিয়া মেনে নিতে পারছে না। এরপরের গানের ক্লাসে যাবার সময় যখন ও ছেলেটাকে আর কোথাও দেখতে পেল না তখন যেন ছেলেটার প্রতি কেমন মায়া জন্মালো। আহা রে! ছেলেটা বোধহয় বুঝতে পেরেছে রিয়া ওকে পছন্দ করছে না। পছন্দ করছে না, ওর এরকম করে দাঁড়ানোটা কিংবা হাঁ করে তাকিয়ে থাকাটা। সেইজন্যই হয়তো লজ্জায় পড়ে আর আসছে না দোকানে। আহা, বেচারা! দোকানে এসে দু একটা সিগারেট খেত সেটাও আর হলো না। এটা ভেবে কেমন একটা কষ্ট হলো রিয়ার। একইসঙ্গে একটু হতাশও হলো। ও চাইছিল ওর জন্য কেউ এসে ওখানে বসে থাকুক। ক্লাস সেরে ফেরার পথে ওই ছেলেটার কথাই বারবার চিন্তা করছিল ও। মনে করার চেষ্টা করল ছেলেটার মুখ। ছেলেটি সুশ্রীই দেখতে। কোন মেয়ে পছন্দ করবে না, এমন নয়। প্রপোজ করলে দশজনের মধ্যে তিন চারজন মেয়ে যে অনায়াসে হ্যাঁ বলবে, এই ব্যাপারে সে একেবারে নিশ্চিত। ছেলেটার চেহারা, গড়ন সবই ভালো। এখনো তেমন কোনো বদমাইশি কাজ করতে সে দেখেনি, তাই চরিত্রও ভালো হবে বোধহয়। রিয়া শুধু জানে না ,ছেলেটা কী কাজ করে। সত্যি কোনো কাজ করে না রংবাজি করে বেড়ায়? তবু রিয়ার মনে হতে লাগল ছেলেটা অন্য বখাটে ছেলেদের মতো নয়। হয়তো কোনো চাকরি করে, বাইরে থাকে। হয়তো বাড়ি ফিরেছে ছুটি নিয়ে। আচমকা সে একটা আশ্চর্য কাজ করে ফেলল। তার মন এত দ্রুত দৌড়াচ্ছে যে ওকে বশ মানাতেই পারছে না। ও ভাবতে শুরু করলো, ছেলেটা যদি ওকে গোলাপ টোলাপ দিয়ে প্রপোজ করত কিংবা চিঠি লিখে জানাতো তার মনের কথা, তবে রিয়া তখন কী করত? পরিস্থিতিটা কল্পনা করার চেষ্টা করলো সে। এইসব উদ্ভট কল্পনাগুলো ওর মাথায় খুব সহজেই চলে আসে। হয়তো এমন হলো, গানের ক্লাস সেরে দিদির বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে আসছে সে। তারপর সাইকেল নিতে গিয়ে অবাক হয়ে যাবে। হয়তো সাইকেলের ঝুড়িতে একটা চিঠি পড়ে থাকবে। তারপর হয়তো সে চারিদিকে তাকিয়ে চিঠিখানা তুলে ফেলবে। তারপর সে কী করবে? হয়তো বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে চিঠিখানা পড়বে। হয়তো চিঠিটার ছত্রে ছত্রে ওর রূপ-গুণের বর্ণনা থাকবে কিংবা হয়তো থাকবে প্রেমালাপ। শেষে হয়তো সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা থাকবে, "আই লাভ ইউ রিয়া। ইতি তোমার―" নাম হয়তো থাকবে না। রিয়া ভাবতে লাগলো, ঠিক কী হতো ওর প্রতিক্রিয়া। হাতের লেখা বা লেখার ধরন দেখে হয়তো মনে প্রাথমিক ভালোলাগাটা তৈরি হবে। যেহেতু আগে থেকে ছেলেটাকে সে জানে সেহেতু চিঠিটা পড়ে মনে আনন্দও হতে পারে। ছেলেটা যে খারাপ হবে তা মনে হচ্ছে না। বিশেষত ওর একটা ধারণা আছে যাদের হাতের অক্ষর ভালো তারা ভালো চরিত্রের হয়। তাছাড়া আজকাল ওর বান্ধবীরা যেভাবে আজেবাজে ছেলেদের সাথে প্রেম করছে সেই হিসেবে এই ছেলেটাকে অনেক ভালো বলেই মনে হলো ওর। কিংবা যদি চিঠিটা এভাবে না দিয়ে রাস্তায় পথ আটকে ছেলেটা বলতো, "একটু দাঁড়াবেন আপনি? একটা কথা বলার ছিল।" তারপর হয়তো জামার পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতো, "চিঠিটা পড়ে দেখবেন। তবে আমি আপনাকে জোর করব না। শুধু নিজের মতামতটা জানাবেন।" এই বলে ছেলেটা হয়তো চলে যেত, আর পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখতো চিঠিটা ও ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে কি না। তখন কি রিয়া ছেলেটাকে মেনে নিত? যদিও রাস্তা আটকে একটু অভব্যতা করেছে কিন্তু কথাবার্তা ভালো করেই বলেছে। জোরজবরদস্তি করেনি বা ওকে অপ্রস্তুতে ফেলেনি। তা ছাড়া কাউকে ভালো লাগলে লোকে এমন কিছু করেই থাকে। ছেলেটাকে মাফ করে দেওয়াই যায়। আর চিঠির উত্তরে "হ্যাঁ" বলাটাও খুব একটা খারাপ হবে না। রিয়া যতবারই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারগুলোকে বিভিন্নভাবে ভাবছে ততবারই সে দেখল, ছেলেটার প্রস্তাবে ওর উত্তর "হ্যাঁ" আসছে। ব্যাপারটা ভেবেই ওর ভীষণ হাসি পেল। সে আজ পর্যন্ত কোন প্রেম করেনি। প্রেম করবার ইচ্ছে যে নেই তা নয়। তা বলে এই ছেলেটা? দুজনকে পাশাপাশি কল্পনা করে আর একবার নিজের মনেই হেসে নিল সে। দোকানটা এসে পড়ায় ওড়নাটা গলা থেকে নামিয়ে বুকের কাছে এনে রাখল। আর ঠিক তখনই ও ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। এই তো সেই ছেলেটা! তবে আজ আর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে নেই। দোকান পেরিয়ে কিছুটা রাস্তা এগিয়ে এসে একটা বাবলা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে আজ সিগারেট নেই, তবে রয়েছে একখানা মোবাইল। পাশে একটা বেঞ্চি থাকলেও সেখানে সে না বসে গাছেই হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজও প্রথম দিনের মতই পরেছে জিন্স, গায়ে সুন্দর একটা জামা। কব্জিতে রয়েছে ঘড়ি, আর চোখে চশমা। সত্যি কথা বলতে কি, আজ অনেকটা সুন্দর লাগলো ছেলেটাকে দেখতে। কিন্তু রিয়া ভাবতে পারেনি ছেলেটা আবার দাঁড়িয়ে থাকবে। শুধু দাঁড়িয়ে থাকা নয়, কিছুটা এগিয়ে এসে নির্জন রাস্তায় অপেক্ষা করছে। এই দুই ব্যাপারে হকচকিয়ে গিয়েও সামলে নিল সে। ছেলেটাকে অতিক্রম করে গিয়ে পিছন ফিরে আবার তাকিয়ে দেখলো। রিয়া দেখল, ছেলেটা কেমন যেন উদাস মুখ করে ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষনের জন্য সে কী করবে ভেবে পেল না।ছেলেটার উপস্থিতি ও একেবারেই আশা করেনি। ছেলেটার সাহস দেখে অবাক হয়ে গেল আজ আর দোকানের সামনে দাঁড়ায়নি। নির্জন রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। প্রপোজ-ট্রপোজ করবে কি? যদিও সে ছেলেটার হাতে গোলাপ বা চিঠি জাতীয় কিছু দেখেনি। ছেলেটা নির্ঘাত প্রেমে পড়েছে রিয়ার। কোনো সন্দেহই নেই এই ব্যাপারে। তাই যদি হয়, অমন করে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখাটা রিয়ার ঠিক হয়নি। ছেলেটা কী ভাবলো কে জানে? এটাকেই সে গ্রীন সিগন্যাল বলে ভেবে নিল না তো? তবে এটা সত্যি, ছেলেটাকে আজ আগের দিনের থেকে দেখতে অনেক ভালো লাগছিল। সেই হিসেবে রিয়া আজ অনেক অর্ডিনারি পোশাকেই গেছিল। অনেক পুরনো একটা চুড়িদার পরেছিলো সে। হালকা ময়লাও বোধহয় হয়ে গেছিল। ছেলেটা রাস্তায় সিগারেট খেতে ভালো জামা প্যান্ট পরে আসছে। আর ও গানের ক্লাসে যাচ্ছে পুরনো আদ্দ্যিকালের একটা জামা পরে। এই কথাটা ভেবেই ওর কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগলো। মা অনেকবার বলে নতুন জামা কাপড় গুলো পরতে, একটু সাজগোজ করতে। কিন্তু ও নিজে চাকচিক্য পছন্দ করেনা বলে নতুন পোশাককে অতটা গুরুত্ব দেয় না। তার মানে এই না যে সে নোংরা জামাকাপড় পরে থাকে। আসলে রাস্তায় সেজেগুজে বেরোতেই ওর কেমন লজ্জা লাগে। তবে আজ প্রথমবার তার সেই চাকচিক্য নেই বলে, সাজগোজ করে না বলে খুব খারাপ লাগলো ওর।

পরেরদিন ক্লাসে যাবার আগে আলমারি থেকে সুন্দর দেখতে আকাশী রঙের একটা সালোয়ার কামিজ বের করলো সে। এরপর হালকা করে একটু সেজেও নিল। রিয়া বুঝতে পারল, মুখে কিছু না বললেও ওর মা বেশ অবাক হয়েছে ওকে এই রূপে দেখে। তবে খুশি হয়েছে কিনা তা মায়ের মুখ দেখে বোঝা গেল না। তারপর একসময় সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পরলো সে। আজ আর যাওয়ার সময় তেমন চিন্তা হলো না ওর। ছেলেটা থাকলে থাকবে, সিগারেট খেলে খাবে। ও সাইকেল চালিয়ে যেমন যায় তেমনই যাবে। কেউ যখন কাউকে ডিস্টার্ব করছে না তখন অতশত ভেবে লাভ নেই। যে কারুর যে কাউকে ভালো লাগতেই পারে। সেটা দোষের কিছু না। রিয়াকে হয়তো ছেলেটার ভালো লেগেছে। তা লাগুক। ইচ্ছে হলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকুক। সে তো আর ছেলেটাকে চোখ বন্ধ করে রাখতে বলতে পারে না।আজও ফেরার সময় ছেলেটাকে দেখতে পেল সেই একই জায়গায়। তবে আজ বাবলা গাছে হেলান না দিয়ে বেঞ্চিতে বসে আছে। পাশে একটা বাচ্চা ছেলে মোবাইল নিয়ে খেলছে। ছেলেটার হাতে আজ রয়েছে একটা বই। সাইকেলের শব্দ শুনে ছেলেটা মুখ তুলে তাকাল। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে চোখাচোখি হতেই একটু হাসলো ছেলেটা। এরপর আগের মতোই চুপচাপ তাকিয়ে রইল ওর দিকে, যতক্ষণ না রিয়া ওর চোখের থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। রিয়া আজ আর অতটা অবাক হয়নি। বেঞ্চে বসতে পারে, ওর দিকে তাকাতেও পারে, এমনকি ইচ্ছে হলে হাসতেও পারে। কিন্তু অবাক হল হাতে বই দেখে। তার মানে, ছেলেটা পড়াশোনা করে। অর্থাৎ, যতটা খারাপ সে ওর সম্পর্কে ভেবেছিল ততটা খারাপ সে নয়। যদিও ছেলেটাকে ওর কখনো লোফার টাইপের মনে হয়নি। কিন্তু আজ বই পড়তে দেখে ওর সম্পর্কে রিয়ার মনে শ্রদ্ধা এল। ছি ছি! কী যা তা ভেবেছে এতদিন সে ওই ছেলেটা সম্পর্কে। নির্জন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে পথ আটকে অসভ্যতা করবে, জোর করে হাত ধরে টানাটানি করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ভীষণ লজ্জা লাগল রিয়ার। লোকে ঠিকই বলে যে বইয়ের কভার দেখে বই বিচার করতে নেই। অনেক পুরনো আপ্তবাক্যটা ওর মনে পড়ে গেল। সে ভাবল, ছেলেটার যদি ওকে ভালোই লেগে থাকে তবে সে বলছে না কেন? ভয় পাচ্ছে কি? পথ আটকে প্রপোজ করতে গেলে ও যদি চড় কষিয়ে দেয় কিংবা চিৎকার করে লোকজন জড়ো করে সেই ভয়ে? প্রেমে পড়েছে অথচ ডেয়ারিং কিছু দেখা যাচ্ছে না, এই ব্যাপারটাই ভাবিয়ে তুলল রিয়াকে। ওর মনে হলো ছেলেটা বেশ ভীরু। আনরোমান্টিকও বটে। কী করে মেয়েদের মন জয় করতে হয় ছেলেটার সে বিদ্যা জানা নেই। প্রপোজ করতে কেউ এত সময় নেয় বলে ওর জানা ছিল না। ওর বান্ধবীদের ক্ষেত্রেই যেমন, প্রথমদিন টিউশনে দেখা, ভালো লাগা। ব্যস, পরের দিন টিউশনে প্রপোজ। অথচ এখানে দেখো, এত বড় ধাড়ী ছেলে রাস্তায় শুধু চুপচাপ দাঁড়ায়, আর একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। আরে বাবা, কিছু তো একটা বল? এই ভাবে তুই মেয়ে পটাবি? একদম ব্যাকডেটেড! রিয়ার মনে হল ছেলেটাকে প্রপোজ করার একটা সুযোগ দেওয়া দরকার। একসেপ্ট সে করবে না, তাই সেটা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো, ছেলেটা লাজুক। তাই তার লজ্জা ভাঙ্গানো দরকার। রিয়ার ক্ষেত্রে হলোনা ঠিক আছে, কিন্তু এরপর কাউকে ভালো লাগলে তখন তো কাজে দেবে না কি? একটু রিহার্সাল থাকা ভালো!সে ঠিক করলো, পরেরদিন খুব আস্তে আস্তে সাইকেল চালিয়ে যাবে। কিংবা দোকান সংলগ্ন রাস্তাটা হেঁটেই আসবে। দোকানটা চোখের আড়াল হলে আবার নাহয় সে সাইকেলে চড়ে বসবে। মোদ্দা ব্যাপার হলো, ছেলেটাকে চান্স দিয়ে দেখতে হবে। ছেলেটার উপর করুণা হল রিয়ার। ওর জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে ছেলেটাকে এভাবে সুযোগ দিত না। রিয়া আসলে ছেলেটার মুখ থেকে "প্রপোজাল"-টা শুনতে চায়। তারপর না হয় আমার "বয়ফ্রেন্ড" আছে বলে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু ছেলেটার মনের কথা জানা দরকার।মাঝখানের দিনটা ভীষণ ছটফটে কাটলো ওর। নতুন কিছু ঘটবে সেই আশায় আমরা যেমন উদগ্রীব হয়ে বসে থাকি তেমনি করেই রিয়ার দুইদিন কাটলো। আজকে আবার একটা নতুন জামা বের করল সে। এই লাল রঙের জামাটা ওকে ওর মামা পুজোয় দিয়েছিল এবং সেটা সে গতবছরই পুজোয় শেষবার পরেছিল। এতদিন পর জামাটা আলমারি থেকে বের করে ও প্রথমে খানিক গন্ধ শুঁকলো, যেমন করে লোকে নতুন বই বা পোশাকের গন্ধ শোঁকে। ন্যাপথলিনের গন্ধে জামাটা তখন একেবারে নতুনই লাগছে। জামাটা পরে নিয়ে পাঁচ-ছয়বার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলো ঠিক হয়েছে কিনা। একবার তো মাকে গিয়ে নিজের সাজ দেখিয়ে এলো। তবে আজ মা জিজ্ঞেস করেই ফেললো,"কী ব্যাপার বল তো? আজকাল নতুন নতুন জামা বের করছিস? সেগুলো পরে ক্লাসে যাচ্ছিস?" রিয়া হেসেউত্তর দিলো,"তাহলে খুলে দেব কি? পুরোনোগুলোই পরে যাই? কী বলো?" মা আর কিছু না বললেও রিয়াকে যে বেশ সন্দেহ করছে তা মায়ের মুখ দেখেই বোঝা গেল। রিয়া গ্রাহ্য করলো না। আজই তো শেষবারের মতো এভাবে যাচ্ছে। একদিন মা সন্দেহ করলই বা! কী এমন ক্ষতি হয়ে যাবে? বেশ কয়েকবার আয়নার সামনে নিজেকে দেখার পর সে সন্তুষ্ট হল। যা সাধারণত সে কোনদিন করে না, আজ তাই করল। চোখে কাজল লাগালো, ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক লাগালো। ফিটফাট হয়ে শেষবারের মতো সে যখন আয়নার সামনে গেলো তখন তার নিজেকেই বেশ অচেনা বলে মনে হলো। সাজলে যে সত্যিই ওকে আরো ভালো লাগে তা যেন সে নতুন করে অনুভব করলো। আজ ওকে এইভাবে দেখে যেকোনো ছেলেই প্রেমে পড়ে যাবে! কিন্তু অন্য ছেলেকে নিয়ে ওর মাথাব্যথা নেই। সেই ভীরু, লাজুক ছেলেটা যদি আজ ওকে প্রপোজ করে তাহলেই ওর সাজা সার্থক।

যদিও রিয়ার মন বলছে, ছেলেটা যা ভীরু এতকিছু কান্ডের পরে আজও চুপচাপ বেঞ্চিতে বসে স্রেফ হাসি দিতে পারে। এগিয়ে এসে রিয়াকে প্রপোজ করার সাহস নাও হতে পারে। ছেলেটার প্রতি কি একটু বেশি এটেনশন দেওয়া হচ্ছে? আজ প্রপোজ করলে করুক না হলে আর কোনদিন পাত্তাই দিবে না। যদিও সে একবারও ভেবে দেখেনি প্রপোজ করার পর রিজেক্ট করলে ছেলেটির মুখের কেমন দশা হবে। আসলে ও জানে এটা সিরিয়াস কিছু ব্যাপার না। রিয়া শুধু তার মনের কথাটা শুনতে চায়। ব্যস, এইটুকুই তার চাওয়া। প্রেম সে করবে না। যাবার সময় ছেলেটার সঙ্গে দেখা হবার আশা সে করেনি, দেখাও অবশ্য হয়নি। দিদির বাড়িতে গিয়ে বারবার অমনোযোগী হয়ে পড়ল রিয়া। দিদি বকুনিও দিল কয়েকবার। কিন্তু ছটপটানিটা কিছুতেই গেল না। তার মাথায় শুধু ঘুরছে, কতক্ষণে সে ওখান থেকে বেরোবে। গান করতে করতে তার মাথায় খেলতে লাগল আজ কী ঘটনা ঘটবে আর তার প্রতিক্রিয়া কী হবে। দিদি একবার তো জিজ্ঞেস করেই ফেললো, "কী ব্যাপার বল তো? আজ এত চঞ্চল কেন? কারুর সঙ্গে দেখা করার কথা আছে না কি?" রিয়া লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল,"কী যে বলো না তুমি?" দিদি হেসে ফেললো,"আচ্ছা ঠিক আছে বলতে হবে না। এখন তো গানটা ঠিক করে কর?" এই কথা শোনার পর মন দিয়ে গান না করলে মান আর থাকে না। এরপর বেশ কষ্ট করেই সে গানে মন দিল।চলে আসার আগে সে একবার বাথরুমে গেল। চুলটা একটু ঠিক করে নিল আয়নার সামনে গিয়ে। ব্যাগ থেকে লিপস্টিকটা বের করে আর একবার হালকা করে লাগিয়ে নিল। বেশ কয়েকবার করে দেখে নিল সব ঠিক আছে কি না, ওকে ঠিক মানাচ্ছে কি না।

যখন ওখান থেকে বেরোলো তখন সে অজানা উত্তেজনায় কাঁপছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হচ্ছে। আর যতই ও দোকানটার দিকে এগোচ্ছে ততই যেন বুকের ওঠানামা বাড়ছে। সে যেন পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে।কিন্তু দোকানটার কাছে পৌঁছে সে যেন একটা জোর ধাক্কা খেলো। হৃৎস্পন্দন যেন আচমকা থেমে গেল। এদিক ওদিক করে সে সবদিকেই চোখ বোলালো। কিন্তু কোথায় সেই ছেলেটা? আশেপাশে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না কেন? আজ কি দোকানের ভেতরে বসে সিগারেট খাচ্ছে? একসময় হেঁটে হেঁটেই দোকানটা পেরিয়ে গেল সে। অন্যান্য দিনের মতো আজও অন্যান্য ছেলেরা সেখানে আড্ডা মারছে। ভারতের অর্থনীতির দুর্দশা নিয়ে গভীর আলোচনা চলছে। কিন্তু সেই ছেলেটা কই? যার জন্য সে এত সেজেগুজে এসেছে, রাস্তাতে হেঁটে যাচ্ছে। সেই ছেলেটা কি তাড়াতাড়ি চলে গেল? নিজের মনেই প্রশ্নটা করল সে। দিদির বাড়িতে বাথরুমে খানিক দেরি হয়েছিল বটে। কিন্তু সে আর কতক্ষণ? মিনিট দশেক হবে ম্যাক্সিমাম। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই কি ছেলেটা চলে গেল? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাইকেলে উঠে পড়লো রিয়া। তার পুরো সাজগোজ আজ মাঠে মারা গেল। এমন হবে জানলে সে মোটেও সাজতো না। প্রচন্ড রাগ হলো ছেলেটার উপর। কোন টাইম জ্ঞান নেই। ছেলেটা যাতে প্রপোজ করার সাহস পায় সেই ভেবে এত কষ্ট করে সেজেগুজে এলো। আর ছেলেটা এর কোন মূল্যই দিল না? যেদিন সেজে যাবে না সেদিন হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। অথচ আজ― মনে মনে ছেলেটার উপর ভীষণ রাগ হলেও যখন ভাবতে শুরু করলো কেন আজ সে আসেনি ততই তার রাগটা কমতে লাগলো। হতে পারে আজ কোনো কাজে আটকা পড়েছে কিংবা সে হয়তো অসুস্থ। তাছাড়া সে তো আর জানে না যে রিয়া সেজেগুজে আসবে। তারই বা দোষ কী?

পরের দিনও একই সাজে একইভাবে ক্লাসে গেল রিয়া। যার জন্য সাজা সেই যখন আগেরদিন ছিল না তখন আবার নতুন সাজে সাজার মানে নেই। কিন্তু আজও একরাশ মন খারাপ নিয়ে সে বাড়ি ফিরল সে। ছেলেটা আজও আসেনি।

পরের দিনও এল না ছেলেটা। তার পরের দিনও না।

রিয়ার মনটা যেন কেমন কেমন করতে লাগল। কিছুই যেন আর ভালো লাগে না। জীবনে কিছুর একটা অভাব বোধ হতে লাগলো। খাওয়ার সময়ও কী যেন চিন্তা করে। গানের ক্লাসেও তাই। বকুনিও খায়। তার মন জুড়ে শুধু একটাই চিন্তা, ছেলেটা কোথায় হারিয়ে গেল? শরীর খারাপ কি? তাই যদি হয় ওর কি একবার দেখতে যাওয়া উচিত নয়? কিন্তু সে কী হিসেবে যাবে, যাকে সে জানেই না? কাকে জিজ্ঞেস করবে ছেলেটার কথা? দোকানে গিয়ে জানতে চাইবে কি? যদিও বেশ একটা লজ্জার ব্যাপার হবে। কিন্তু খবরটা না জেনে সে কি সুস্থির হতে পারবে? কাউকেও তো খুলেও বলতে পারছে না সে। তার কাছের বন্ধু অদিতিকে জানাবে কী? কিন্তু ব্যাপারটা এতদূর পর্যন্ত গড়িয়ে গেছে যে এখন বললে অদিতি হয়তো বলবে, "আমি তোর এইরকম বন্ধু না? এতদিন ধরে ব্যাপারটা ঘটছে আর আমাকে আজ জানাচ্ছিস?" চাপা স্বভাবের হওয়া এই এক সমস্যা। দিদি কে সব কথা খুলে বলবে কি? দিদি খুবই মিশুক এবং ভালো মনের মানুষ। এমনিতেই দুদিন ধরে জিজ্ঞেস করছিল, কী হয়েছে। ওর মনে পড়লো, দিদির প্রেম করে বিয়ে। দিদি হয়তো এই ব্যাপারটা ভালো বুঝতে পারবে। অনেক ভেবে সে স্থির করলো সব ঘটনা খুলে জানাবে দিদিকে। একটু অভিজ্ঞ লোকের পরামর্শ নেওয়া দরকার এসব ক্ষেত্রে। বেশ বুঝতে পারল রিয়া, ছেলেটা নয়, সে নিজেই ছেলেটার প্রেমে পড়ে গিয়েছে! ✍️✍️✍️

আমার কথা " অনেকদিন পর প্রেমের কোনো গল্প লিখলাম। গল্পটা একটুখানি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার নিয়ে লেখা। পুরোটাই আমার কল্পনা, কতটা সঠিক কল্পনা করতে পেরেছি জানি না। বাস্তবে এইরকম ঘটনার দেখা আমিও অবশ্য কখনো পাইনি বা কখনো শুনিনি। তবুও লিখলাম। এটাই আমার প্রথম লেখা, যেখানে দু একটা বাদে সরাসরি কোনো কথোপকথন নেই। একটু অন্য স্বাদের গল্প লেখার চেষ্টা করেছি মাত্র "।

Writer's picture: Priyabrata SahooPriyabrata Sahoo

Updated: May 23, 2024



আমি হ্যান্ডশেক করে বললাম, "আপনি তাহলে গজেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী? এর আগে আপনার সঙ্গে পরিচয় না হলেও আপনার অনেক কথা আমি শুনেছি।"

গজেন বাবু তখন একটা গরম চপকে কায়দা করতে ব্যস্ত। অর্ধেকটা চপ মুখের ভিতর ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন গরম-ঠান্ডা বিচার না করেই। 'ঠেলার নাম বাবাজি' তা টের পেয়েই না পারছেন গিলতে, না পারছেন ফেলতে। অনেক কায়দা কসরতের পর চপ যখন আয়ত্তে এল তখন গজেনবাবু চোখের জলে, নাকের জলে একাকার হয়ে গেছেন।

গজেন বাবু এরপরও প্লেট থেকে একটা পকোড়া তুলে নিয়ে এমনভাবে দন্ত বিকশিত করলেন যেন খানিক আগে কিছুই ঘটেনি। একগাল হেসে বললেন, "আমার নাম তো শুনবেনই, ওয়েস্টবেঙ্গলে এমন কোন ক্রিমিনাল নেই যে গজেন গাঙ্গুলীর নাম শোনেনি।"

আমি বড় বড় চোখ করে গজেন বাবুর দিকে তাকিয়ে বললাম, "তার মানে আমি ক্রিমিনাল?"

"সে তো বটেই আমি আপনি সবাই ছোট বড় ক্রিমিনাল। কেন, আপনি পিঁপড়ে মারেন না? কেঁচো দিয়ে মাছ ধরেন না? মশা, মাছি, শুয়োপোকা, কেন্নো— এদের মারেন না? তারা কি বাস্তুতন্ত্রের বাইরে যে তাদের মারা ন্যায়সঙ্গত হবে?"

গজেনবাবুর সঙ্গে এইসব কথাবার্তা হচ্ছিল রামগোপালদার বাড়িতে। সঙ্গে আমার সহকর্মী খগেনও ছিল। চা-চপ-পকোড়া আর পিওর দেশি মুড়ি সহযোগে আমাদের সান্ধ্যকালীন আড্ডাটা বেশ জমে উঠেছে।

এখানে আমাদের একটু পরিচয় দেওয়া দরকার আমি আর খগেন একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করি। রামগোপালদা উকিল হিসেবে ইদানিং বেশ পসার জমাতে শুরু করেছেন।আমরা তিনজনই প্রায় সমবয়সী। তবে গজেনদা হলো গিয়ে আমাদের পিসতুতো দাদা— যিনি গোয়েন্দা হিসেবে দারুণ সুনাম কুড়িয়েছেন।

আমার প্রবল ইচ্ছা কোন নামকরা গোয়েন্দার অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে কাজ করি। মানে অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে সবকিছু শিখে-টিখে নিয়ে গোয়েন্দা হবো আর কি।

এইসব প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করা পোষায় না। কখন চাকরি থাকবে আর কখন চলে যাবে তা কেউ বলতে পারে না। তার চেয়ে গোয়েন্দা এজেন্সি খোলা অনেক ভালো। স্বাধীন চাকরি।

তাছাড়া আমি গোয়েন্দাগিরিকে যথেষ্ট প্রীতির চোখে দেখি। শার্লক হোমস, ব্যোমকেশ, ফেলুদা পড়ে জেনেছি পুলিশরা গোয়েন্দাদের রীতিমতো সমীহ করে চলে। এটা একটা বড় পাওনা। কারণ, পুলিশের প্রতি আমার একটা রাগ আছে। একবার হয়েছিল কী, আমি আর আমার শালা বাইকে চড়ে কাঁঠাল নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছিলাম। হঠাৎ মাঝরাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ ধরল। লাইসেন্স থাকা সত্ত্বেও এটা নেই, ওটা নেই, এটা সারাননি কেন, অ্যাক্সিডেন্ট হলে কী করবেন, এসব বায়নাক্কা করে ঘুষ হিসেবে কাঁঠালটাই কেড়ে নিল।

সেবার বউয়ের হাতে শ্বশুর বাড়িতে যা বেইজ্জত হয়েছিলাম তা আর বলার নয়। সেই থেকে সুযোগ খুঁজছি কীভাবে পুলিশকে ধাতানি দেওয়া যায়। তারই উপায় হিসেবে গোয়েন্দা শরণাপন্ন হয়েছি।

তবে এর আগে অন্য কোনো গোয়েন্দার যে খোঁজ পাইনি তা নয়। কিন্তু তাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়া যায় না। কেউ বয়সে ছোট, কারুর মেজাজ তিরিক্ষি, কারুর অলরেডি দুজন অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে। আজ তাই রামগোপালদার বাড়িতে গজেনবাবু এসেছেন খবর পেয়ে না ছুটে এসে পারিনি।

গজেন বাবুর অবশ্য একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে। তবে একজনের বেশি দুজন অ্যাসিস্ট্যান্ট কি রাখতে নেই? সেই আশা-ভরসাতেই আমি ছুটে এসেছি। আর আমার পিছু পিছু খগেন এসেছে গল্প শোনার লোভে।

গজন বাবুর পেশীবহুল চেহারা, ঝাঁকড়া চুল, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যায় তিনি একজন গোয়েন্দা। আপাতদৃষ্টিতে গজেনবাবুকে রাশভারী ও গম্ভীর স্বভাবের মানুষ বলে মনে হলেও তার কথাবার্তা শুনে কিন্তু তা মনে হয় না।

রামগোপালদা চানাচুর চিবুতে চিবুতে বললেন, "তুমি বরং তোমার দু একটা কেসের কাহিনী শোনাও, আমরা সবাই শুনি।"

খগেন আহ্লাদিত হয়ে বলল, "সেই গল্প শুনতেই তো আসা। আসলে কোনো গোয়েন্দা সঙ্গে এর আগে কখনো তো সামনাসামনি সাক্ষাৎ হয়নি, ফেলুদা, কিরীটী, শার্লক হোমস— এদের সঙ্গে বইতেই সাক্ষাৎ ঘটেছে।"


"ছোঃ, ওরা আবার কোনো গোয়েন্দা না কি? গজেনবাবু এমনভাবে নাক মুখ বিকৃত করলেন যেন তাকে কেউ তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তেতো ওষুধ গেলাচ্ছে।"

আমি বেশ খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, "সে কী? এদের নামে অপরাধীরা ভয়ে কাঁপে। কী নিপুণভাবে এরা জটিল সব কেস সমাধান করেছে। আর আপনি বলছেন—"

"আরে বাপু, ওরা তো আর অরিজিন্যাল গোয়েন্দা নয়, সবাই গল্পের চরিত্র। গল্পে যেখানে যা ইচ্ছে সাজিয়ে নেওয়া যায়। ওখানে গোয়েন্দা ক্রিমিনাল দুজনেই একই সুতোয় বাঁধা থাকে, আর লাটাই থাকে লেখকের হাতে। গল্পের সঙ্গে বাস্তবের মিল কতটুকু?"

খগেন তবু মানতে চায় না। বলে, "যাই বলুন, গল্পের গোয়েন্দাদের কৃতিত্বটাও কম নয়।"

রামগোপালদা বিরক্ত হয়ে বললেন, "ওসব বাদ দিয়ে আসল কাহিনীই শোনাও না, তুমি বরং তোমার সেই হিরোইন কেসটাই আমাদের শোনাও, পেপারে খানিকটা পড়েছিলাম।"

চায়ে চুমুক দিয়ে গজেনবাবু বললেন, "আসলে কেসটায় বিশেষ কিছু নেই। ছাগল দিয়ে কি আর ধান চাষ হয়! টালিগঞ্জের এক নামি হিরোইন টুসকি সুচতুর কৌশলে সারা ভারতে হেরোইন ছড়িয়ে দিত। সেই হেরোইনকে হিরোইন কীসের মধ্যে পুরে পাচার করতে জানেন?"

আমি আর খগেন সমস্বরে বলে উঠলুম, "কীসে করে?"

"সিম্পল পলিথিনের প্যাকেটে ভরে জুতোর মধ্যে পুরে পাচার করত।"

খগেন আশ্চর্য হয়ে বলল, "জুতোর মধ্যে কোথায় লুকোতো?"

গজেনবাবু খগেনের পায়ের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, "জুতো মানেই চটিজুতো ভাবছেন কেন? বুট কি জুতো নয়?"

এবার আমি বললাম, "সেই হিরোইন বুটের মধ্যে হেরোইন পাচার করত? বাপরে, কী সাহস!"

"হিরোইন বুট পড়তে যাবে কেন? তার শাগরেদরা পরতো। সে যাই হোক, তাদের বমালসমেত ধরেছিলাম টাটানগরে।"

খগেন চোখ কপালে তুলে বললো, "অ্যাঁ, টালিগঞ্জের মাল টাটানগরে?"

"অবাক হচ্ছেন কেন? এ তো সামান্যই, কলকাতার এক মাফিয়াকে একবার ধরেছিলাম কেরালায়, আর একবার একজনকে পাকড়াও করেছিলাম বঙ্গোপসাগরে।"

খগেন হাঁ করে অবাক বিস্ময় গজেন বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি মিনমিন করে জানতে চাইলাম, "বঙ্গোপসাগরে ধরলেন মানে?"

"কী আশ্চর্য! জলদস্যু বঙ্গোপসাগরে থাকবে না তো কি আপনার বাড়ির পচা ডোবাতে থাকবে? মাথার গ্রে ম্যাটারকে একটু বেশি পরিমাণে খাটান না! আর একবার এক ভন্ড জ্যোতিষীকে পাকড়াও করেছিলাম ভূপৃষ্ঠ থেকে পঁচিশ হাজার ফুট উচ্চতায়।"

খগেন বিড়বিড় করে বলে পঁচিশ হাজার ফুট উচ্চতা!"

"হ্যাঁ, এয়ার ইন্ডিয়ার এক বিমানে চড়ে পালাচ্ছিল। বিমানেই তাকে ধরলাম। আর একবার এক খুনিকে ধরেছিলাম আট হাজার আটশো ষাট মিটার গভীরে।"

আমি আশ্চর্য হয়ে বলি, "এত গভীরে কেমন করে ধরলেন? একেবারেই যে অসম্ভব ব্যাপার।"

"আহা বুঝছেন না কেন, হিসেবটা ভূপৃষ্ঠ থেকে নয়, মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া থেকে। মানে মাটির নিচে বারো মিটার গভীরে এক পাতালঘরেই তাকে ধরেছি।"


কৃতজ্ঞতা স্বীকার : কিশোর ভারতী


এইসব কথাবার্তায় রামগোপালদা হাসেনও না বিস্মিতও হন না, বিরক্ত হন। ভুরু কুঁচকে বলেন, "তোমার ওসব গাঁজাখুরি ব্যাপার-স্যাপার ছেড়ে সোজাসুজি গল্পে এসো তো।"

আসলে উকিল মানুষ তো। 'মাই লর্ড ',  'ইয়োর অনার' ইত্যাদি শুনতে ও বলতেই বেশি অভ্যস্ত। তাই গোয়েন্দা আর ক্রিমিনাল এর মধ্যে কখন সওয়াল জবাব হবে সেই আশাতেই বসে আছেন।

যাইহোক রামগোপালদার বিরক্তি দেখে গজেনবাবু এবার নড়েচড়ে বসলেন। সঙ্গে আমরাও। গজেনবাবু পায়ের উপর পা তুলে চোখ বুজিয়ে মুড়ি চিবুতে চিবুতে বললেন, "তাহলে আমার লাস্ট কেসের গল্পটাই বলি শোনো।

"বেশিদিন নয়, মাত্র পাঁচদিন আগেই "জুলি মার্ডার কেস"- টা আমি সলভ করেছি। ঘটনাটা ঘটেছিল তমলুকে। যে আমি গোটা ভারতবর্ষ থেকে ক্রিমিনালদের পাকড়াও করেছি, সেই আমি এই কেসটায় আমার সর্বোচ্চ বুদ্ধি খাটিয়েও কোন কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না— ভাবতে পারো ব্যাপারটা! একবার একতাল গোবর থেকে এক গরুচোরের খোঁজ পেয়েছিলাম আর একবার একটা চবনপ্রাশের শিশি থেকে এক ভন্ড সাধুর ডেরার সন্ধান মিলেছিল, আর এই কেসে সূত্র বলতে কেবল ক্রিমিনালদের ফটো আর তাদের ডেসক্রিপশন।"

আমি হেসে বললুম, "অনেকে তাও পায় না, আপনি তবু ক্রিমিনালদের নামধাম ডেসক্রিপশন পেয়েছেন।"


"আরে বাপু, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। যাদের সন্দেহ করা হয়েছে ও ফটো পাওয়া গেছে, সেই সময় তাদের মধ্যে একজন জেলের মধ্যেই বহাল তবিয়তে ছিল। আর একজন ছিল দীঘায় মামার বাড়িতে। অন্যজন শ্বশুরালয়ে মহানন্দে ছিল। শেষজন সেদিন বন্ধুদের নিয়ে পিকনিকে ব্যস্ত ছিল। এমনকি তাদের ফটোগুলো সব ছোটবেলাকার।"

খগেন এতক্ষণ পরে মুখ খুলল, "অ্যাঁ, তাহলে মার্ডার করল কে?"

"সেটা বিষ্টুবাবুকেই জিজ্ঞেস করুন। উনি তো একটু আগে আমাকে পাত্তাই দিচ্ছিলেন না।"

নিঃশব্দে ব্যঙ্গটা হজম করে নিলুম।

আমাকে একবার দেখে নিয়ে গজেনবাবু বললেন, "তাহলেই বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা অতটা সাদামাঠা নয়। আর পুলিশ করবে এই কেসের ফয়সালা! হাসালে বালক! এ তো লাঙ্গল করতে বলদ এর বদলে ছাগল!"

কিন্তু রামগোপালদা আজকে যেন বিরক্তির প্রতিমূর্তি হয়ে বসে আছেন। এবারে আর রাগ চেপে রাখতে পারলেন না।

"ধুত্তরি! মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে কি অসুবিধা হচ্ছে?"

"শুরুই তো করতে যাচ্ছিলাম। আসলে ব্যাপারগুলো সব জটিল কিনা তাই জটিল করে না বললে ঠিক বুঝতে পারবেন না। ... দিন দশেক আগে আমি ঘরে বসে পেপার পড়ছিলাম। এমন সময় বছর পঞ্চাশের এক ভদ্রমহিলা আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। বৃদ্ধার বাড়ি তমলুকে। সেখানে তাদের বিশাল সম্পত্তি। বাড়ি, গাড়ি সবই আছে। বাড়িতে কর্তা-গিন্নি দুজনে, আর এক ছেলে ও এক মেয়ে থাকে।

"এনারা একটু বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন। সে যাই হোক, কর্তা এখন বাতের ব্যথায় পঙ্গু, হাঁটাচলা বেশিক্ষণ করতে পারেন না। গিন্নি অবশ্য সবল আছেন। তিনি কাছের একটা স্কুলে শিক্ষকতা করেন।

"বৃদ্ধের নাম পিটার, ভদ্রমহিলার নাম মারিয়ম, ছেলের নাম মাইক, মেয়ের নাম জুলি। তবে রবার্ট নামে জুলির এক ছোট ভাই ছিল, কিন্তু সে বছর খানেক আগে মারা গেছে। তবে নাম শুনে আশ্চর্য হয়ো না, এরা কেউই লর্ড ক্লাইভের বংশধর নয়। এরা সবাই পিওর বাঙালি আর এদের প্রত্যেকের পদবী দাস।

"তা সে যাই হোক, ভদ্রমহিলা এসে বললেন, তাদের আদরের ধন জুলিকে কে বা কারা অপহরণ করেছে। আমি বললাম, তবে পুলিশের কাছে গিয়ে ডায়েরী করুন। ভদ্রমহিলা বললেন, থানায় গিয়ে সবকিছু জানিয়েছি। তবে তাদের যা ভাবগতিক, মিনিমাম খুন না হলে তারা এগোবে বলে মনে হয় না। তাই আপনার কাছে এলাম। আমার জুলিকে যদি খুঁজে দেন তো আপনাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেব।

"বললুম, দেখুন ম্যাডাম, অপহরণ যে করা হয়েছে আপনি সেটা বুঝলেন কী করে?"

"বুঝলাম কী করে? এই চিঠিটা পড়ে দেখুন।"

এই বলে ভদ্রমহিলা একটা চিঠি আমার হাতে দিলেন। তাতে লেখা রয়েছে, "জুলিকে নিয়ে চললাম খোঁজার চেষ্টা করো না। ইতি—জুপির মামা।"

"চিঠিটা দেখে বুঝলাম, আসামি বেশ ধুরন্ধর। হাতের লেখা আড়াল করার জন্য চিঠিটা টাইপ করে দিয়েছে।

"দেখুন, জুপি বলে জুলির কোন মামা আছে কি? যদি থাকে তাহলে তাকে চেপে ধরলেই তো কাজ মিটে যায়। বলেই বুঝতে পারলুম, এটা জিজ্ঞেস করা বোকার মত কাজ হয়ে গেছে। কোন অপরাধী কি তাকে ধরার সুবিধার জন্য পরিচয় দিয়ে যাবে?"

"ওর যদি জুপির বলে কোন মামা থাকে তবে আপনার কাছে আসব কী জন্য? জুলির কোন মামা নেই।"

"দেখুন, জুলিকে যে গুম করা হয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু অপহরণ করার কারণ তো থাকবে, চিঠিতে তো কোনো দাবির উল্লেখ নেই।"

"সেটা আপনি খুঁজে বার করুন।"

"আচ্ছা, কখন টের পেলেন যে জুলি বাড়িতে নেই?"

"সকাল আটটার দিকে। কেন-না ওই সময়ে সে যেখানেই থাকুক না কেন আমার কাছে এসে চা-বিস্কুট দিয়ে দিনের খাওয়া শুরু করে। সাড়ে আটটা বেজে গেল অথচ তার কোন পাত্তাই নেই। চাকর-বাকর দিয়ে তখনই চারদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু হল, আর তারপরই বৈঠকখানায় এই চিঠিটা পাওয়া গেল।"

"ঠিক আছে, আপনি এখন বাড়ি যান যান. বিকেলবেলা আপনার বাড়িতে যাব, যা কিছু জানার আছে সেখানেই জেনে নেব। তবে চিন্তা করবেন না, যেহেতু আজ সকালেই অপহরণ করা হয়েছে বিকেলের দিকে কি দুপুরে মুক্তিপণের দাবিতে কেউ ফোন করতে পারে। ফোন করলে নাম্বারটা গুছিয়ে রাখবেন, পরে কাজে লাগবে। আর নতুন কিছু ঘটলে তখনই জানাবেন।

আমি আমার ফোন নাম্বারটা ভদ্রমহিলাকে দিলাম। উনি সেটা নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন। ওদিকে আমি গেলাম আমার কাজে। ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। পিটারবাবুর বাড়ি যাব বলে তৈরি হচ্ছি, তখনি কাঁদো কাঁদো গলায় ভদ্রমহিলার ফোন এল,"জুলিকে মার্ডার করা হয়েছে।"

"সে কী? মুক্তিপণ চাওয়ার আগেই খুন? কী করে জানতে পারলেন?"

"বাড়ির পাশে ঝোপের মধ্যে তার দেহ পাওয়া গেছে। আমার চাকরই প্রথম দেখতে পেয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। আর আমারে চিনতে মোটেই ভুল হয়নি।"

তখনই আমি পিটারবাবুর বাড়ি ছুটলাম। সেখানে গিয়ে আমিও বডিটা দেখলাম। তবে পুরোটা নয়, ধড় থেকে মুন্ডুটা আলাদা হয়ে পড়ে আছে। নাড়িভুঁড়িগুলো একটা পলিথিনের প্যাকেটে ভরা আছে, প্রত্যেকটা পা-ও ছিটকে পড়ে আছে।"

খগেন শিউরে উঠে বললো, "উফ, কী নৃশংস!"

আমি বললাম, "এরকম করে কেউ কাউকে মারতে পারে? ভাবাই যায় না, মানুষ কী নিষ্ঠুর!"

এতক্ষণে রামগোপালদা কথা বললেন। যেহেতু খুনখারাপি শুরু হয়ে গেছে তাই উনি কাহিনীর মধ্যে রস খুঁজে পেয়েছেন। বললেন, "আমার লাইফেও এরকম একটা কেস এসেছিল। সেবার হয়েছিল কী দুই ভাইয়ের সম্পত্তি নিয়ে—"

পাছে আসল কাহিনী চাপা পড়ে যায় সেই ভয়ে খগেন রামগোপালদাকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য বললো, "তারপর গজেনবাবু কী হলো? আসামিকে ধরতে পারলেন?"

রামগোপালদা তার নিজের কাহিনী বলতে না পারায় ব্যাজার মুখ করে বসে রইলেন। ওদিকে গজেনবাবু শুরু করে দিয়েছেন।

"ডেডবডিটা দেখে তো আমার রক্ত গরম হয়ে উঠল। ওদিকে পিটারবাবুদের কান্না দেখে আমার তখন যে কী অবস্থা তা তোমাদের কী বলবো। ... তারপরই শুরু করে দিলাম জিজ্ঞাসাবাদ। চাকর-বাকর থেকে শুরু করে কেউ বাদ গেল না। আর আমার যে কী, তা তো আপনারা জানেন না। কিছুক্ষণ পর সবাই কাহিল হয়ে পড়ল। পিটারবাবুরা কাদের সন্দেহ করেন সেটাও জানলাম। তারা সম্ভাব্য অপরাধীদের সম্পর্কে যথেষ্ট বিবরণ ও পারিবারিক অ্যালবাম থেকে তাদের ছোটবেলাকার ফটোও দিল।

"এখন আমার দায়িত্ব হল বিচার-বিশ্লেষণ করে সবার ভেতর থেকে আসল খুনিকে খুজে বের করা। বেশ বুঝতে পারলাম, পিটারবাবুরা যাদের সন্দেহ করেন তারা ওদের নিকটাত্মীয়, না হলে তাদের ফটো পারিবারিক অ্যালবামে থাকতো না।

"তারপরে খোঁজখবর নিয়ে জানলাম যাদেরকে সন্দেহ করা হয়েছে তাদের মধ্যে গোবিন্দ জুলির অপহরণের আগে থেকেই মামাবাড়ি গেছে। ক্যাবলা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে জেল হাজতে আছে পনেরোদিন হল। এটা পিটার বাবুরা জানতেন না। হাবলু ওদিকে শ্বশুরবাড়িতে। আর শেষজন মাইক সারাদিন বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে পিকনিকে ছিল।"

খগেন অবাক হয়ে বললো, "পিটারবাবুরা তাহলে নিজের ছেলেকেও সন্দেহের বাইরে রাখেনি?"

উত্তরে গজেনবাবু শুধু মুচকি হাসলেন, "ওই চিঠি ছাড়া অপরাধী এমন কোন ক্লু রাখেনি যাতে তাকে ধরা যায়। তাছাড়া সন্দেহের তালিকার বাইরে থাকা অন্য কোন ব্যক্তিও এই কাজ করতে পারে।

গজেনবাবু এরপর জোরে টেবিল চাপড়ে বললেন, "শুধুই তো কিডন্যাপ নয়, মার্ডারও। আসামিকে ধরতে না পারলে আমার নামে কালি পড়ে যাবে। আমার তখন উদভ্রান্ত অবস্থা, নিজেই নিজের উপর বিরক্ত। চার দিন কেটে গেছে অথচ আজ আমি তখনও নাগালের বাইরে।

"সেদিন দুপুরে বিছানায় শুয়ে অন্যমনস্কভাবে ওদের সবার নামগুলো মনে করছিলাম—জুলি, পিটার, রবার্ট, মাইক, মা। আর পরক্ষনেই চমকে উঠলাম। আরে প্রত্যেকটা নামের প্রথম অক্ষরগুলো নিলেই তো দাঁড়ায় "জুপির মামা" । এটাই তো চিঠিতে লেখা ছিল।

"আমি তড়াক করে বিছানায় উঠে বসলাম। একটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। নামগুলো থেকে কর্তা গিন্নির নাম অবশ্যই বাদ দেওয়া যায়, কেননা তারা জুলিকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো এবং জুলির মার্ডারে এদের কোন প্রফিট নেই। রবার্ট তো আগেই মারা গেছে, তাহলে বাকি থাকে কেবলমাত্র মাইক। তবে মাইক কি অপরাধী? কেননা ও সন্দেহের লিস্টে আছে।"

খগেন বলল, "দূর, তা হয় না কি? মাইক নিজের বোনকে খুন করবে কেন? এতে তার প্রফিট কী?"

আমি বললাম, "সম্পত্তির লোভেও তো হতে পারে।"

"কেন? জুলি বিয়ে হলে এমনিতেই তো মাইক সবকিছু পেত। খুন করার মত বোকামি সে করবে কেন?"

"এমনও তো হতে পারে পিটার হয়তো মাইককে কিছুই দিত না।"

এইবার গজেনবাবু বাধা দিয়ে বললেন, "থামুন, থামুন। আসল ঘটনাটা শুনুন। সংকেতটা বুঝতে পারার পরদিনই মাইকের উপর নজরদারি চালালাম। শেষকালে চেপে ধরতেই মাইক ধরা পড়ে গেল।"

রামগোপালদা জিজ্ঞেস করলেন, "মাইক কেন মার্ডার করল?"

গজেনবাবু ঢকঢক করে খানিকটা জল খেয়ে বললেন, "পিটারবাবুদের বাড়িতে মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল, বিশেষত জন্মাবার পর থেকে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি মাইক জুলিকে স্নেহের চোখে দেখত না। একবার তো বিক্রি পর্যন্ত করে দিতে উদ্যত হয়েছিল। সবচেয়ে বড় প্রমাণ মাইক ও তার বন্ধুরা পিকনিকে মাংস খাচ্ছিল।"

খগেন যেন সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনার কথাই শুনল। বলল, "পিকনিকে মাংস খাবে— এতে কী দোষ? তাছাড়া মাংস খাওয়ার সঙ্গে জুলির মার্ডারের সম্পর্ক কী? আচ্ছা মাইকের কি শাস্তি হয়েছিল?"

"এইজন্যে মাইক তার মাষ্টারমশাইয়ের কাছ থেকে আচ্ছা করে বকুনি আর পিটুনি খেয়েছিল।"

রামগোপালদা উকিল মানুষ, অবাক হয়ে বললেন, "সে কী? অপহরণ ও খুনের শাস্তি বকুনি ও পিটুনি? আচ্ছা এটা ভারতীয় আইনের কোন ধারায় পড়ে?"

গজেনবাবু এইবার রীতিমতো হতাশ হয়ে বললেন, "আসলে তোমরা এখনো ব্যাপারটা বুঝতে পারছ না? জুলি ছিল পিটারবাবুদের অতি আদরের পোষ্য পাঁঠার নাম!!"

"অ্যাঁ, পাঁঠা!" বলে খগেন আর আমি গজেনবাবুর মুখের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলাম।

বলা বাহুল্য, এখনও আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়ার জন্য উপযুক্ত গোয়েন্দার খোঁজে রয়েছি। কেন-না পাঁঠা মার্ডার কেসে ঘাম ছুটে যাওয়া গোয়েন্দার অ্যাসিস্ট্যান্ট হতে আমার কোনো ইচ্ছে নেই।

✍️✍️✍️



আমার কথা: এই হাসির গল্পটা কলেজে প্রথম বর্ষে থাকাকালীন লিখি। তারপর সেটা পাঠিয়ে দিই ছোটদের জনপ্ৰিয় "কিশোর ভারতী" পত্রিকায় এবং সেটা ছাপাও হয় ২০১৫, জানুয়ারিতে। আজ অনেকদিন পর সেই গল্পটাই এখানে পুরো তুলে দিলাম। 

সৌজন্যে: কিশোর ভারতী

Contact
Information

Energy Materials Laboratory

Centre for Nano and Soft Matter Sciences

Shivanapura, Dasanapura Hobli
Bengaluru, Karnataka, India, 562 162

+91 8101713394

  • Google Scholar
  • ResearchGate
  • ORCID
  • Researcher ID
  • LinkedIn

Thanks for submitting!

©2024 by Priyabrata Sahoo

bottom of page